
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত বিমান ও স্থল হামলায় একের পর এক বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার (১৬ মে) সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও অন্তত ১১৫ জন ফিলিস্তিনি। একই সময়ে আহত হয়েছেন আরও ২১৬ জনের বেশি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও বহু মরদেহ আটকে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ফলে নিহত ও আহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। উদ্ধারকর্মীরা পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় অনেক জায়গায় পৌঁছাতে পারছেন না।
এই ২৪ ঘণ্টার হামলার মধ্য দিয়ে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি অভিযানে নিহত ফিলিস্তিনির মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ১১৯ জনে। এছাড়া আহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জন। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, নিহত ও আহতদের অন্তত ৫৬ শতাংশই নারী ও শিশু, যারা সরাসরি সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত ছিল না।
৭ অক্টোবরের পর থেকে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে অতর্কিতে একটি বিস্ময়কর হামলা চালায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা গুলি ও রকেট হামলায় ১,২০০ ইসরাইলিকে হত্যা করে এবং অন্তত ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। এই ঘটনার জবাবে একই দিন থেকেই গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী, যা এক পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ নেয়।
এই দেড় বছরের বেশি সময়ের মধ্যে ইসরাইলি বাহিনী গাজার বেসামরিক অবকাঠামো—বসতবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির—সবকিছুকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে বলে অভিযোগ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের। জাতিসংঘও একাধিকবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, গাজায় ইসরাইল যে অভিযান চালাচ্ছে তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা ও পুনরায় অভিযান
চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত ১৯ জানুয়ারি ইসরাইল যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, কাতারসহ একাধিক মধ্যস্থতাকারী দেশ এই বিরতিতে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু এই যুদ্ধবিরতি টিকতে পারেনি এক মাসের বেশি। মার্চের ১৮ তারিখে আবারও গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ, যা এখন পর্যন্ত প্রতিদিনই প্রাণ নিচ্ছে অসংখ্য ফিলিস্তিনির।
এই দ্বিতীয় দফার অভিযানে গত দুই মাসে ইতোমধ্যেই নিহত হয়েছেন আরও অন্তত ২,৯৮৫ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন ৮,১৭৩ জনের মতো মানুষ। প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ৫০ জন নিহত হচ্ছেন এই ধাপে, যাদের অনেকেই নারী ও শিশু।
জিম্মিদের মুক্ত করতে ‘যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া’র ঘোষণা
হামাস যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হওয়া ২৫১ জন ইসরাইলি জিম্মির মধ্যে এখনও অন্তত ৩৫ জন জীবিত রয়েছে বলে দাবি করছে আইডিএফ। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যতদিন পর্যন্ত না এই জিম্মিদের মুক্ত করা যাবে এবং হামাসকে সামরিক ও সাংগঠনিকভাবে ধ্বংস করা যাবে, ততদিন গাজায় অভিযান অব্যাহত থাকবে।
নেতানিয়াহুর এই অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বান সত্ত্বেও বদলায়নি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ এবং আন্তর্জাতিক কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) একাধিকবার গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছে। আইসিজেতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার অভিযোগে’ মামলা পর্যন্ত দায়ের হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ইসরাইল-গাজা সংঘাতে।
মানবিক বিপর্যয় আরও ঘনীভূত
গাজায় পরিস্থিতি দিন দিন আরও মানবিক বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা, আশ্রয়—সবকিছুরই ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে, পুরো গাজা উপত্যকার ৯০ শতাংশ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রাফাহ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে ইসরাইলি অভিযান ও অবরোধের কারণে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো প্রায় বন্ধ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিনের এই দমনমূলক সামরিক অভিযান কেবল গাজাকে ধ্বংসই করছে না, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই নতুন উত্তেজনা ও সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যেটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এদিকে গাজাবাসীদের এই চরম দুর্ভোগ ও গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠলেও ইসরাইল তার অবস্থান থেকে একচুলও সরেনি। বরং নেতানিয়াহু প্রশাসনের বক্তব্য, “গাজা থেকে হামাসের মূলোৎপাটন না হওয়া পর্যন্ত আমরা পিছু হটবো না।”
এই অবস্থায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে গাজা সংকট সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখা যেমন সময়ের দাবি, তেমনি ফিলিস্তিনিদের জীবন রক্ষার লড়াইটিও হয়ে উঠেছে এক বৈশ্বিক নৈতিক পরীক্ষার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ