
গাজার সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা বাসেম নাঈম। ছবি: রয়টার্স
গাজা উপত্যকার স্বাধীনতা, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে কোনো আপস নয়—এমনই কঠোর বার্তা দিয়েছে ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস। তাদের স্পষ্ট বক্তব্য, গাজা কোনো পণ্য নয়, এটি বিক্রির বস্তুও নয়। একইসঙ্গে তারা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ‘গাজা রূপান্তর পরিকল্পনা’কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ও গাজার সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. বাসেম নাঈম এই প্রতিক্রিয়া জানান।
শুক্রবার (১৬ মে) সৌদি আরবের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আল-হাদাথকে দেওয়া এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে ডা. নাঈম বলেন, "গাজা ফিলিস্তিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কোনো দখলযোগ্য জমি কিংবা বিক্রির জন্য পণ্য নয়। এটি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্মভূমি এবং বেঁচে থাকার অবলম্বন। এখানে আমাদের শেকড়, আত্মত্যাগের ইতিহাস এবং দীর্ঘ প্রতিরোধের চেতনা রয়েছে।"
তিনি জোর দিয়ে বলেন, "যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরাইল গাজায় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেয়, এবং মানবিক সহায়তা অবাধে প্রবেশের সুযোগ না দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোনো ধরনের আলোচনার ব্যাপারেই চিন্তা করবো না। সহিংসতা বন্ধের আলোচনা আগে নয়, মানবিক অধিকার নিশ্চিত করাই অগ্রাধিকার।"
ট্রাম্পের প্রস্তাব: পরিকল্পিত উচ্ছেদ?
ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি কাতারে এক আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে তার পুরনো ‘গাজা রূপান্তর পরিকল্পনা’ আবারও সামনে আনেন। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবার তিনি এ পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন, যাতে গাজা উপত্যকার জনগণকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ট্রাম্প বলেন, “ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে এখন আর রক্ষার মতো কিছু নেই। গাজাকে উন্নয়ন অঞ্চল হিসেবে পুনর্গঠন করা সম্ভব।”
এই বক্তব্যের জেরে পুরো আরব বিশ্বে এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে নতুন করে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আরব দেশগুলোসহ জাতিসংঘও ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা একে “গণউচ্ছেদের” পরিকল্পনা হিসেবে বর্ণনা করে সতর্ক করেছে যে, এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
হামাসের নেতা বাসেম নাঈম বলেন, "ট্রাম্পের এই প্রস্তাব মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হতে পারে। এ ধরনের পরিকল্পনা কেবল ইসরাইলের দখলদার নীতিকেই উৎসাহিত করে, যা সম্পূর্ণভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর এক ভয়াবহ অন্যায়। গাজার জনগণ কোনোভাবেই তাদের ভূমি ছাড়বে না, এবং গাজাকে আরেকটি কলোনিতে পরিণত করার ষড়যন্ত্রও সফল হবে না।"
চলমান যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়
অপরদিকে, দখলদার ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) গাজা উপত্যকার ওপর আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। শুক্রবার (১৬ মে) একদিনেই ইসরাইলি বিমান, স্থল ও নৌ হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৪৩ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও কয়েকশ মানুষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা শহরের বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো বহু মানুষ চাপা পড়ে আছেন, যাদের অনেককে জীবিত উদ্ধারের আশা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার জবাবে ইসরাইলি বাহিনী ‘পূর্ণ সামরিক অভিযান’ শুরু করে গাজায়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫৩ হাজার ১১৯ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশু মিলিয়ে অন্তত ৫৬ শতাংশ।
এই দীর্ঘ অভিযানে বহু আবাসিক এলাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়েছে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। জাতিসংঘ এই পরিস্থিতিকে ‘গণবিধ্বংসী হামলা’ হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও যুদ্ধবিরতির চাপ
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে বারবার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়লেও এখনো হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) এবং একাধিক মানবাধিকার সংস্থা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ তদন্ত করছে।
ট্রাম্পের প্রস্তাব এবং নেতানিয়াহুর অবস্থান একে অপরকে সহায়তা করছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে গাজার জনগণের জন্য আর কোনো স্বাভাবিক জীবনের আশা থাকবে না। এটি একটি সম্পূর্ণ পরিকল্পিত জাতিগত নির্মূল প্রক্রিয়ার অংশ, যা মানবসভ্যতার জন্য হুমকি।”
হামাসের বার্তা: প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে
ডা. বাসেম নাঈম সাক্ষাৎকারের শেষাংশে বলেন, "গাজার জনগণ তাদের জীবন, ভূমি ও মর্যাদার জন্য যা করার প্রয়োজন, তা-ই করবে। আমাদের কাছে স্বাধীনতা বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। ট্রাম্প কিংবা নেতানিয়াহু কেউই আমাদের সংকল্প ভাঙতে পারবে না। গাজা শুধু একটি ভূখণ্ড নয়—এটি আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের লড়াইয়ের প্রতীক।"
বিশ্ব কূটনীতিতে উত্তেজনা বাড়াতে থাকা এই সংঘাতের ভবিষ্যৎ এখনও অজানা। তবে গাজা উপত্যকাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে, এবং মানবিক বিপর্যয় পৌঁছাচ্ছে ভয়াবহ সীমায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ