
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ—যেখানে দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার অবস্থিত—সেই বাজারে কুরবানির ঈদ সামনে রেখে মসলাজাতীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন রীতিমতো আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মসলার দাম কেজিতে ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এসব পণ্য আমদানি হয়েছে তিন থেকে চার মাস আগে, এবং কাস্টমস বিভাগের মতে, বর্তমানে বাজারে মসলাজাতীয় পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই।
বাজারে সিন্ডিকেটের দাপট
ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের অভিযোগ, পুরো মসলার বাজার এখন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। এই সিন্ডিকেট কুরবানির ঈদের সময়কার অতিরিক্ত চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে পণ্যের মূল্য একচেটিয়াভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে। খাতুনগঞ্জের কয়েকজন খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে মসলা আছে, কিন্তু দাম বাড়ানোর ‘সুযোগ’ কাজে লাগাচ্ছে সিন্ডিকেট।
চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ কাস্টমস কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমদানি করা মসলার পরিমাণ এবং পণ্যের স্টক পর্যাপ্ত। কাস্টমস দ্রুত খালাস দিচ্ছে। বাজারে সংকট হওয়ার প্রশ্নই আসে না।”
কোন কোন মসলার দাম কত বাড়লো?
গত এক সপ্তাহের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে এলাচ, জয়ত্রী, লবঙ্গ ও জিরার মতো উচ্চমূল্যের মসলার।
লবঙ্গ: এক সপ্তাহ আগে ছিল ১২০০ টাকা/কেজি, এখন ১৪০০ টাকা।
জিরা: মানভেদে ছিল ৫৫৭ টাকা, এখন ৬০০ টাকা/কেজি।
গোলমরিচ: ৭৫০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৮০০ টাকা/কেজি।
দারুচিনি: ৪০০ টাকা/কেজি।
হলুদ: ৩৫০ টাকা/কেজি।
কালিজিরা: ৩২০ টাকা/কেজি।
জয়ত্রী: কেজিতে ৫০–৮০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকায়।
সাদা সরিষা: ৩০০ টাকা/কেজি।
কিশমিশ: ৮০০ টাকা/কেজি।
তেজপাতা: ১২০ টাকা/কেজি।
পেঁয়াজ: ভারতীয় পেঁয়াজ পাইকারি ৫০–৫৫ টাকা, খুচরায় ৬০–৬৫ টাকা।
এলাচের দাম সামান্য কমেছে বলে জানানো হয়েছে। যেখানে একসময় প্রতি কেজি ৪৮০০ টাকা ছিল, এখন তা কিছুটা কমে ৪৫০০ টাকায় এসেছে।
কী বলছে আমদানি পরিসংখ্যান?
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে দেশে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টন মসলাজাতীয় পণ্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
রসুন: ৯৯,৮৫৮ টন
আদা: ২১,০১৯ টন
হলুদ: ৪,৩২৮ টন
দারুচিনি: ১০,৫৪৩ টন
লবঙ্গ: ২,১৫৪ টন
এলাচ: ১,৬১৪ টন
কিশমিশ: ৪,৮২৩ টন
গোলমরিচ: ১,০৯৯ টন
জয়ত্রী: ২৯০ টন
জায়ফল: ২৭২ টন
ব্যবসায়ীদের দাবি: ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজার দায়ী
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “ডলার সংকট এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে মসলার দামও বেড়েছে।”
তার দাবি, সরকার মসলাকে বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে বিবেচনা করায় এ খাতে ৫০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হয়। ফলে খরচও বেড়ে যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে—যে পণ্যগুলো তিন মাস আগেই আমদানি করা হয়েছে, সেইসব পণ্যের দাম হঠাৎ বাড়ার যৌক্তিকতা কোথায়?
গবেষণা ও পর্যালোচনা
বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্র বলছে, দেশে বছরে প্রায় ৩৩ লাখ টন মসলার চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ২৭ লাখ টনের বেশি দেশেই উৎপাদিত হয়। বাকিটুকু ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা হয়। বেশিরভাগ মসলা সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশে আসে।
ভোক্তার অভিযোগ
মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা গৃহবধূ রুবিনা সুলতানা বলেন, “ঈদের সময় যেসব মসলা লাগে, তার সবকিছুর দামই এখন ডাবল। আগেই কিনতে গেলে দাম বেশি, পরে কিনতেও ভয় লাগে আরও বেশি হবে কিনা।”
ঢাকার মালিবাগের মসলা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা পাইকারি বাজার থেকেই বেশি দামে পণ্য নিচ্ছি। আমাদের কিছু করার নেই। সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে স্থিতিশীলতা আসে না।”
সরকারি মনিটরিং কোথায়?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি মনিটরিং কার্যকর না থাকায় সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে। টিসিবি বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নজরদারি শুধুই শহুরে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।
অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, “সরকার যদি এলসি অনুমোদন, শুল্কহার হ্রাস এবং মনিটরিং একসাথে কার্যকরভাবে করে, তাহলে মসলা সহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”
ঈদ সামনে রেখে যেভাবে একের পর এক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে, তা শুধু ভোক্তাদের নয়, গোটা অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের সিন্ডিকেট ভাঙা এবং বাজারে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। নয়তো ঈদের আনন্দ চাপা পড়ে যাবে পণ্যের দামের হাহাকারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ