
ছবি: সংগৃহীত
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে দীর্ঘদিন ধরে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে, তা এখন আর চাপা থাকছে না। ঝুলে আছে গুরুত্বপূর্ণ পদোন্নতি, জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ ও প্রত্যাহার এবং সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি। বছরের পর বছর ধরে যে প্রশাসন কাঠামো নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে এসেছে, বর্তমানে সেখানে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা ও সিদ্ধান্তহীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে করে শুধু প্রশাসনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে না, পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা, ক্ষোভ ও পেশাগত উদ্বেগ।
পদোন্নতির ফাঁদে আটকে আছে দুই ব্যাচ
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০তম ও ৩০তম ব্যাচের বহু কর্মকর্তা দীর্ঘ সময় ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় আছেন। বিশেষ করে ২০তম ব্যাচের যুগ্মসচিবদের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির বিষয়টি মাসের পর মাস ঝুলে আছে। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সভা হচ্ছে না, ফলে কার্যক্রম প্রায় বন্ধের পর্যায়ে। একই অবস্থা ৩০তম ব্যাচের ক্ষেত্রেও। এক বছর আগে উপসচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হলেও এসএসবি সভা না হওয়ায় তারা থেমে আছেন সেই শুরুর জায়গাতেই।
আরো জটিল পরিস্থিতির মুখে পড়েছে ২৪তম ব্যাচ। এই ব্যাচের মোট ৩৪৪ জন কর্মকর্তার মধ্যে ১৯৬ জন যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পেলেও বঞ্চিত হয়েছেন ১৮০ জন। এক ব্যাচে এত বড় সংখ্যায় বঞ্চিত হওয়ার নজির অতীতে নেই বললেই চলে। বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মতে, রাজনৈতিক আনুগত্যের অভিযোগে একরকম দলবদ্ধভাবে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। হতাশা আর ক্ষোভে ফুঁসছেন এই কর্মকর্তারা। তাদের একজন প্রশ্ন তুলেছেন, “১৮০ জন সবাই কি ফ্যাসিবাদের দোসর?”
দুই মাস আগে এই বঞ্চনার রিভিউ প্রক্রিয়া শুরু হলেও আজ পর্যন্ত তা চূড়ান্ত হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতায় হারিয়ে যাচ্ছে।
ডিসি ফিটলিস্ট ও পদায়নের নামে সময়ক্ষেপণ
গত বছরের নভেম্বর থেকে জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগের জন্য ফিটলিস্ট তৈরি শুরু হয়। যাচাই-বাছাই শেষে ২৫ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো হয় শতাধিক কর্মকর্তার তালিকা। দুই মাস সময় লেগে গেল অনুমোদন পেতে। এরপর আবার তা উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে—কবে অনুমোদন মিলবে, কেউ জানে না।
বর্তমানে মাঠ প্রশাসনে ২৬ জন ডিসি রয়েছেন যারা সবাই ২৪তম ব্যাচের। এর মধ্যে ২১ জন সম্প্রতি যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন, অথচ এখনো ডিসি হিসেবেই কর্মরত। নিয়ম অনুযায়ী যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর তাদের প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটিও হয়নি।
বিশেষ করে যারা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েও এখনো ডিসি হিসেবে মাঠে আছেন—তাদের অবস্থা আরও করুণ। তারা মনে করছেন, পেশাগতভাবে তারা এক অস্বস্তিকর ও অসম অবস্থানে রয়েছেন। তাদের মধ্যে খুলনা, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাটোর ও জামালপুরের ডিসিরা রয়েছেন।
সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মচারীদের চার দফা দাবি
জনপ্রশাসনের স্থবিরতার একটি বড় দিক হচ্ছে সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা। পদনাম পরিবর্তনসহ চারটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি গত সাত-আট মাস ধরে কোনো অগ্রগতি ছাড়াই পড়ে আছে। তারা জনপ্রশাসন সচিব, ভূমি সচিব, অর্থ সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বারবার স্মারকলিপি দিয়েছেন, দেখা করেছেন, তবুও কাজের কাজ কিছু হয়নি।
গত মার্চ মাসে তারা সচিবালয়ের ভেতরে মহাসমাবেশের আয়োজন করলেও আশ্বাস পেয়ে পিছু হটেন। এখন আবারো আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কর্মচারীরা বলছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে।
সম্পদ বিবরণী গ্রহণ, কিন্তু এরপর কী?
সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী নেওয়া হলেও, এখন পর্যন্ত সেই তথ্য নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি মন্ত্রণালয়। এটি নিয়েও এক শ্রেণির কর্মকর্তার মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও শঙ্কা কাজ করছে। তারা জানেন না, এই বিবরণী কীভাবে ব্যবহার করা হবে, কিংবা আদৌ কোনো তদন্ত হবে কিনা।
‘যোগ্য নেতৃত্ব ও সদিচ্ছার অভাবেই এই অবস্থার সৃষ্টি’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘‘বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে আছে। প্রত্যেকটি উইংয়ে দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাচ্ছেন কর্মকর্তারা।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘যদি উপযুক্ত লোকদের যথাস্থানে বসানো না হয়, তবে এই স্থবিরতা কাটবে না। সরকারকে অবশ্যই সদিচ্ছা দেখাতে হবে। নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে উপদেষ্টা কমিটির সদস্যরা যাদের প্রশাসন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই, তাদের দিয়ে এই প্রক্রিয়া পরিচালনা করাটা অনর্থক। এতে শুধু দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে, দক্ষ প্রশাসনের বারোটা বাজে।’’
রাজনৈতিক আনুগত্যের ছাপ প্রশাসনে
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বর্তমান সরকারের সমর্থক আমলাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। কারণ গত প্রায় দেড় যুগে যারা কর্তৃত্ব করেছেন, তাদের অনেক অনুগত কর্মকর্তা এখন নানা অভিযোগে বিতর্কিত। বিশেষ করে যারা দলীয় আনুগত্য দেখিয়েছেন এবং সাধারণ মানুষের কাছে অজনপ্রিয় হয়েছেন—তাদের পদায়ন নিয়ে সরকার নিজেই বিপাকে। অন্যদিকে দলনিরপেক্ষ, দক্ষ কর্মকর্তা প্রয়োজন হলেও পদোন্নতি ছাড়া সেই সংকট মেটানো সম্ভব নয়।
নিরব প্রশাসন, ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা কেবলমাত্র সময়ক্ষেপণ নয়—বরং এটি একটি গভীর কাঠামোগত সংকেট। যে মন্ত্রণালয়টি পুরো দেশের প্রশাসনিক চাকা সচল রাখার দায়িত্বে, তার ভেতরেই যদি স্থবিরতা বিরাজ করে, তাহলে তা গোটা শাসন ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে—এটি এখন স্পষ্ট।
যোগ্যতা ও দক্ষতা বিবেচনায় নয়, বরং রাজনৈতিক রেফারেন্স ও আতঙ্কের ভিত্তিতে যদি সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে প্রশাসন কেবল মুখ থুবড়ে পড়বে না, এর চরম মূল্য দিতে হবে রাষ্ট্র ও জনগণকেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—সরকার কি এই অচলাবস্থার সমাধানে আন্তরিক, না কি শুধুই সময় পার করছে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ