
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া শত শত কোটি টাকার সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার নতুন এক কঠোর ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সাবেক আত্মীয় এবং আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছয়টি শিল্প গোষ্ঠীর নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের সন্ধান মিলেছে। এসব অর্থসম্পদ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ও আমিরাতের মধ্যে একটি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স চুক্তি (এমএলএটি) চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে দেশ দুটি যৌথভাবে কাজ করবে।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্তে ছয় সংস্থা
জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও তাদের ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে ছয়টি জাতীয় সংস্থা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত করছে। সংস্থাগুলো হচ্ছে—বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), সিআইডি এবং সদ্য বিলুপ্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব সংস্থার তদন্তে বিভিন্ন পর্যায়ে এসব শিল্প গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে, যার বেশির ভাগই ইউএই-তে অবস্থিত।
গভর্নরের দুবাই সফর ও বৈঠকসমূহ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের প্রধান ড. আহসান এইচ মনসুর বর্তমানে আমিরাত সফর করছেন। তিনি ইউএই-এর ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (UAE FIU), সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইউএই, এবং সেখানে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধকারী বিভিন্ন এজেন্টের সঙ্গে বৈঠক করছেন। পাশাপাশি স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করছেন, যাতে তারা পাচার হওয়া অর্থ এবং জড়িতদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন।
সুনির্দিষ্ট সম্পদের অনুসন্ধান ও আইনি পদক্ষেপ
তদন্তে উঠে এসেছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী এবং আরামিট গ্রুপের মালিক সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের নামে আমিরাতে ২২৮টি অভিজাত ফ্ল্যাটের তথ্য। এসব ফ্ল্যাটের কিছু পুনরায় বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের প্রমাণও পাওয়া গেছে। তার পরিবারের সদস্যরাও দেশটিতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।
দুর্নীতির আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান। তার বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার পাচারের অভিযোগ রয়েছে, যার বড় একটি অংশ এসেছে রপ্তানির আয়ের অর্থ দেশে না এনে বিদেশে ‘শেল কোম্পানি’ তৈরি করে বিনিয়োগের মাধ্যমে। এই শেল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে তিনি শুধু আমিরাত নয়, আরও একাধিক দেশে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
একটি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্পগ্রুপের মালিকপক্ষের সদস্যদের নামে ১২ কোটি ৪০ লাখ টাকার একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক বিনিয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একইভাবে, ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিম ও তার সহযোগীরা ইউএই-তে বিপুল সম্পদ বিনিয়োগ করেছেন। তারা আলবেনিয়ার নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানকার পরিচয় ব্যবহার করে আমিরাতে বিনিয়োগ করেছেন।
প্রয়াত শিল্পপতি কাজী শাহেদ আহমেদের জেমকম গ্রুপ এবং নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে শেল কোম্পানি খুলে বিদেশে ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষভাবে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের এক আত্মীয়—যিনি তার শাসনামলে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন—তার নামেও ইউএইতে বিপুল সম্পদ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার সময় পাচার হওয়া অর্থের অংশ তিনি ভোগ করেছেন এবং তার মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করেছেন।
এমএলএআর ও এমএলএটি উদ্যোগ: আইনি কাঠামোর উন্নয়ন
বিএফআইইউ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমন্বয়ে ইউএই সরকারের কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (MLAR) পাঠানো হয়েছে, যার মাধ্যমে পাচার হওয়া সম্পদের তথ্য ও সেগুলো ফেরত আনার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর বাইরে মালয়েশিয়া, চীন, হংকংসহ ১০টি দেশের সঙ্গে স্থায়ী মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স ট্রিটি (MLAT) চুক্তি করার প্রক্রিয়া চলমান।
বর্তমানে কেবল ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের এই চুক্তি রয়েছে। আমিরাত এবং মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের কাজ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। চুক্তির খসড়া বাংলাদেশ পর্যালোচনা করছে এবং দু’দেশের আইনি কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় করে তা অনুমোদন দেওয়ার অপেক্ষায়।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও তথ্য আদান-প্রদান
বাংলাদেশ বিএফআইইউ এখন পর্যন্ত ৮১টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে ইউএই অন্যতম। এ ছাড়া, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধকারী সংস্থা Egmont Group-এর সদস্য দেশগুলোর সহযোগিতা নিচ্ছে, যারা প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদানে ভূমিকা রাখছে।
টাকা পাচারের গন্তব্য ও সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
বিএফআইইউ এর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হয়েছে—কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনে। এই দেশগুলোর সঙ্গে আইনি চুক্তি ছাড়া পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই সরকার কূটনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সব পথে এই দেশগুলোর সঙ্গে আইনগত সহায়তা কাঠামো গড়ার চেষ্টা করছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মাহবুবুল আলম বলেন, “বাংলাদেশের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যদি সরকার রাজনৈতিক বাধা ছাড়িয়ে এই আইনি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে পারে। তখন শুধু অর্থ নয়, দুর্নীতির শেকড়ও ধ্বংস হবে।”
টিআইবি-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই তখনই কার্যকর হয়, যখন দুর্নীতির লাভজনকতা নষ্ট করে দেওয়া যায়। পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনা মানেই দুর্নীতির মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেওয়া।”
এই তদন্ত, আইনি পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার একটি বড় অংশ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব বলে আশা করা যায়। একই সঙ্গে এটি একটি স্পষ্ট বার্তা যে, ভবিষ্যতে কোনো সরকারই অবাধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার করে দায়মুক্তি পাবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ