
ছবি: সংগৃহীত
যৌনস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা এবং গবেষণার গুরুত্ব বিশ্বজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে। নানা ধরনের যৌনরোগ বা এসটিডি (Sexually Transmitted Diseases)-এর মধ্যে অন্যতম একটি ভয়াবহ রোগ হলো গনোরিয়া। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের তেমন কোনো লক্ষণ দেখা না গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। নারী ও পুরুষ—দুই পক্ষের ক্ষেত্রেই এই রোগের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রয়েছে, যা প্রজননক্ষমতা হ্রাসের মতো মারাত্মক জটিলতায়ও গড়াতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটেনের গবেষকেরা আশার আলো দেখাচ্ছেন। যৌনবাহিত এই রোগ নির্মূল করতে যে ওষুধ এতদিন শুধুমাত্র মূত্রনালির সংক্রমণে ব্যবহার হতো, সেটিকেই নতুনভাবে রূপান্তর করে যৌনরোগ প্রতিরোধে কার্যকর একটি অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে আনতে চলেছেন তারা।
অ্যান্টিবায়োটিক ‘জেপোটিডাসিন’: পুরনো উপাদানে নতুন সাফল্য
‘জেপোটিডাসিন’ নামে এই অ্যান্টিবায়োটিকটি আগে কেবলমাত্র ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মূত্রনালির সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো। তবে ব্রিটেনের হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সির বিজ্ঞানীরা এই ওষুধটির গঠনে পরিবর্তন এনে যৌনরোগের ক্ষেত্রেও এর কার্যকারিতা যাচাই করছেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেট–এ প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে জানানো হয়েছে, জেপোটিডাসিন যৌনবাহিত রোগ, বিশেষ করে গনোরিয়ার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
গবেষণাগারে প্রথমে ইঁদুরের শরীরে ওষুধটি প্রয়োগ করা হয় এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্য মেলে। পরবর্তীতে গনোরিয়ায় আক্রান্ত নারী ও পুরুষদের ওপর ওষুধটি প্রয়োগ করে দেখা যায়, রোগ নিরাময়ের হার প্রায় ৯৩ শতাংশ। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন বিজ্ঞানী কেটি সিঙ্কা। তিনি জানিয়েছেন, পরীক্ষামূলক প্রয়োগে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়েছে, যা ভবিষ্যতে রোগের পুনরাবৃত্তি রোধেও কার্যকর হতে পারে।
নিসেরিয়া গনোরি: ভয়াবহ এক জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই
গনোরিয়া রোগটি মূলত "নিসেরিয়া গনোরি" নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। এটি একটি অত্যন্ত সংক্রামক যৌনবাহিত জীবাণু, যা প্রাথমিকভাবে মূত্রনালি, যৌনাঙ্গ, গলা এবং রেক্টামে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
নারীদের ক্ষেত্রে এই রোগে ঋতুচক্রের মাঝামাঝি সময় ‘স্পটিং’ বা রক্তপাত দেখা দিতে পারে। প্রস্রাবের সময় তীব্র জ্বালাভাব হতে পারে। চিকিৎসা না করালে ব্যাকটেরিয়াটি জরায়ু ও ফ্যালোপিয়ান টিউব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে বন্ধ্যাত্ব, ‘টিউবাল প্রেগন্যান্সি’সহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।
পুরুষদের ক্ষেত্রেও রোগটি ভয়াবহ হতে পারে। সংক্রমণের ফলে প্রস্রাবে জ্বালা, কষাকষি ব্যথা, এবং অণ্ডকোষে অস্বস্তি দেখা দেয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করলে শুক্রাণু উৎপাদনের হার কমে গিয়ে সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা দেখা দিতে পারে। ফলে, গনোরিয়া কেবল একটি যৌনবাহিত সংক্রমণ নয়, বরং এটি একটি সম্ভাব্য সামাজিক ও পারিবারিক সংকটের জন্ম দিতে পারে।
৬২৮ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা, সাফল্যের হার আশাব্যঞ্জক
গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী যৌনরোগের প্রকোপ বাড়ছে, এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জেপোটিডাসিন নামের নতুনভাবে রূপান্তরিত অ্যান্টিবায়োটিকটি হতে পারে একটি যুগান্তকারী চিকিৎসা। ব্রিটিশ গবেষণা দলটি এই ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেছে ৬২৮ জন গনোরিয়ায় আক্রান্ত নারী ও পুরুষের ওপর। তাদের মধ্যে অধিকাংশ রোগীর সংক্রমণ ৯০ শতাংশের বেশি সেরে যায়।
গবেষক কেটি সিঙ্কা বলেন, “যৌনরোগের চিকিৎসায় ওষুধ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক বিকল্প খুব জরুরি ছিল। আমাদের গবেষণায় প্রাথমিক ফলাফল অত্যন্ত ইতিবাচক।” তিনি আরও জানান, প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও নিরাপত্তা পরীক্ষা শেষ হলে, এই ওষুধটি খুব শিগগিরই বাজারে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
যৌনস্বাস্থ্যে বিপ্লবের সম্ভাবনা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর গনোরিয়ায় আক্রান্ত হন অন্তত ৮ কোটি মানুষ। এর মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে যৌনস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলনামূলক দুর্বল হওয়ায় রোগটি অনেক সময় শনাক্তই হয় না।
এই অবস্থায় জেপোটিডাসিন ভিত্তিক নতুন অ্যান্টিবায়োটিক যৌনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে। বিশেষ করে যুবসমাজ এবং উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুত এবং নিরাপদ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে এটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে ওষুধটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অনুমোদন পেলে তা যৌনরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রথম নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে বিশ্বজুড়ে ব্যবহার শুরু হবে। এভাবে যৌনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায় আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ