
ছবি: সংগৃহীত
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সম্প্রতি পুশ-ব্যাকের ঘটনাগুলো উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ভারত থেকে যাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বহু বছর ধরে গুজরাট, রাজস্থান কিংবা ওড়িশার মতো রাজ্যে বসবাস করছিলেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক মামলা, এমনকি আদালতে হাজির করার প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হয়নি। মানবাধিকার কর্মীরা এটিকে ভারতের সংবিধান, আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবিক মূল্যবোধের চরম লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করছেন।
‘পুশ-ব্যাক’ না ‘পুশ-ইন’?
এই প্রক্রিয়াটি একদিকে যেমন ভারত দাবি করছে ‘পুশ-ব্যাক’, বাংলাদেশের দৃষ্টিতে সেটি একটি 'পুশ-ইন', অর্থাৎ জোর করে নিজের ভূখণ্ডে বিদেশি নাগরিককে ঢুকিয়ে দেওয়া। ভারতের কোনও আইনেই এই ধরনের পদ্ধতির অনুমোদন নেই। তবুও বাস্তবে দীর্ঘদিন ধরেই এই অনানুষ্ঠানিক ‘নিষিদ্ধ প্রথা’ চলমান রয়েছে, যা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কিংবা কেন্দ্রীয় সরকার কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না।
বিবিসি বাংলার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সাম্প্রতিক কালে গুজরাট ও রাজস্থানে হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি সন্দেহে ধরপাকড় হয়েছে। গুজরাটের কিছু বন্দিকে ত্রিপুরার আগরতলায় এনে সীমান্তে পাঠানো হয়েছে। এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর সীমান্তে মাঝরাতে পুশ-ব্যাকের চেষ্টাও হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও এসব ঘটনায় প্রমাণ বা পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট দলিল নেই।
মানবাধিকার সংগঠনের আপত্তি
ভারতের মানবাধিকার সংগঠন MASUM-এর প্রধান কিরীটী রায় বলেন, “ভারতের মাটিতে বিদেশি নাগরিকেরাও সংবিধান অনুযায়ী ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন। পুশ-ব্যাক সম্পূর্ণভাবে আইনবহির্ভূত। যদি সত্যিই কেউ পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া আসে, তাহলে তাকে আদালতে তোলা, মামলা দায়ের করা, বিচার শেষে সাজা হওয়া এবং তারপর তার নিজ দেশে ফেরত পাঠানো এই পুরো প্রক্রিয়াটিই আইনি পথ। কিন্তু তা হচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, “সাম্প্রতিক যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ধৃতদের বেশিরভাগকেই কোনো বিচার ছাড়াই সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি পরিবারকেও জানানো হচ্ছে না কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং সংবিধানেরও চরম অবমাননা।”
'অপরাধী' না কি 'পরিযায়ী শ্রমিক'?
গুজরাট এবং রাজস্থানের স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলো বলছে, যাদের বাংলাদেশি বলে আটক করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া হিন্দিভাষী বা বাংলা ভাষাভাষী শ্রমিক। পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক বলেন, “আমরা প্রায় ৭০০ জনের মতো মানুষের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। তাদের মধ্যে মাত্র একজনকে আদালতে তোলা হয়েছে, বাকিদের সরাসরি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে পাঠিয়ে ‘বাংলাদেশি’ ঘোষণা করে সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, “আমরা চেষ্টা করছি স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে যাদের প্রকৃত পরিচয় পশ্চিমবঙ্গের, তাদের যেন না ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই ধরণের শনাক্তকরণ ছাড়াই একধরনের চাপে পড়ে প্রশাসন পুশ-ব্যাক চালাচ্ছে।”
প্রশাসনের ব্যাখ্যা: ‘জেল ফাঁকা নেই’
গুজরাট পুলিশ ও বিএসএফ-এর সঙ্গে কথা বলে বিবিসি জানতে পেরেছে, বহু রাজ্যে একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি সন্দেহে ধৃত ব্যক্তি রয়েছে। তাদের সবাইকে গ্রেফতার দেখালে দীর্ঘ মেয়াদি জেল, বিচারিক প্রক্রিয়া এবং পরে দূতাবাসের মাধ্যমে ফেরত পাঠানোর মতো সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল ও প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হয়।
এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জেলগুলোতে আর জায়গা নেই। এভাবে মামলা চালালে অন্য বন্দীদের বার করতে হবে। সেজন্য কার্যকর সমাধান হিসেবে সরাসরি পুশ-ব্যাক করাই বেছে নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।”
কিন্তু আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মীরা একে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অবহেলা এবং বিচারবহির্ভূত কাজ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, “পুশ-ব্যাক একটি নীরব রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের উপকরণ হয়ে উঠছে, যেখানে কেউ কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না, কোনো আইন প্রয়োগ হচ্ছে না।”
নারী ও শিশুদের মানবিক ফেরত?
একমাত্র যে জায়গায় বিএসএফ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুটা নমনীয়তা দেখায় তা হলো পাচার হওয়া শিশু এবং নারীদের ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে যৌথ বোঝাপড়ায় মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। তবে সেটিও অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে এবং জিরো লাইনে নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা শেষে সম্পন্ন হয়।
কূটনৈতিক দ্বিধা ও নিরবতা
এই ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকার এখনও পর্যন্ত খুব একটা স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউই সরাসরি এই ‘পুশ-ব্যাক’ ইস্যু নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে সীমান্তে পুশ-ব্যাকের ঘটনা বাড়তে থাকায় বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) বাড়তি নজরদারি শুরু করেছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, “ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে ফেরত পাঠাতে চাইলে আমাদের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু এভাবে রাতের আঁধারে ধৃতদের ঠেলে দেওয়া আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চুক্তি ও মানবাধিকার নীতিমালার পরিপন্থী।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত এই পদ্ধতির মাধ্যমে একটি অনানুষ্ঠানিক, অস্বীকারযোগ্য অভিবাসন নীতি চালু করছে, যেটি পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ায় এক বিপজ্জনক নজির স্থাপন করতে পারে। এশিয়া প্যাসিফিক হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্কের গবেষক ড. সায়ন্তনী চক্রবর্তী বলেন, “যদি এই রীতি স্বাভাবিকীকরণ পায়, তাহলে আগামীতে আরও বড় আকারে রাষ্ট্রীয় পুশ-ব্যাক শুরু হতে পারে, যার ফলে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও মানবাধিকার চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের অভ্যন্তরে থাকা অন্য প্রতিবেশী দেশের নাগরিকরাও এই অব্যবস্থার শিকার হতে পারেন, বিশেষ করে যারা খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী।”
ভারতের অভ্যন্তরে ধৃত বাংলাদেশিদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে রাতের আঁধারে সীমান্তে ঠেলে দেওয়ার প্রক্রিয়া এখনই বন্ধ না হলে এটি কেবল মানবাধিকার নয়, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। প্রয়োজন একটি যৌথ, স্বচ্ছ ও মানবিক কাঠামো—যেখানে বিচারিক প্রক্রিয়া ও আইনের শাসন বজায় থাকবে, আর রাষ্ট্রীয় গাফিলতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ