
ছবি: সংগৃহীত
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকা সাবেক বিডিআর সদস্যদের মধ্যে ২৭ জন বৃহস্পতিবার জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। সকালে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের তিনটি ইউনিট থেকে তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার, পার্ট-১ এবং পার্ট-২ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত এসব বন্দিরা সকাল ১০টা নাগাদ কারাগারের প্রধান ফটকে পৌঁছান। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা। মুক্তির মুহূর্তে স্বজনদের মধ্যে আবেগঘন দৃশ্য দেখা যায়; অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন, আবার কেউ কেউ দীর্ঘদিন পর প্রিয়জনকে ফিরে পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, মামলার আসামিপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে গেল ১৩ মে (সোমবার) ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত বিশেষ আদালত—প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ইব্রাহীম মিয়া মোট ৪০ জন আসামির জামিন মঞ্জুর করেন।
এই ৪০ জনের মধ্যে বৃহস্পতিবার সকালে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১২ জন, কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১ থেকে ৫ জন এবং পার্ট-২ থেকে ১০ জন মুক্তি পান। এর আগের দিন বুধবার আরও একজন বিডিআর সদস্য একই মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন।
জামিনে মুক্তি পাওয়া সাবেক বিডিআর সদস্যদের বেশিরভাগই দীর্ঘ সময় ধরে বিচারাধীন মামলায় আটক ছিলেন। এর আগে বিডিআর বিদ্রোহের সময় সংঘটিত হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া ১৭৮ জন আসামিও পরবর্তীতে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় জামিন পান। সব মিলিয়ে এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ২১৮ জন সাবেক বিডিআর সদস্য জামিনে মুক্তি পেলেন।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ আল মামুন সাংবাদিকদের জানান, “জামিনপ্রাপ্ত ২৭ জন বন্দির কাগজপত্র আদালত থেকে কারাগারে পৌঁছানোর পর তা যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বৃহস্পতিবার সকালে তাদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।”
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হন। এই ভয়াবহ ঘটনার পর একাধিক মামলা হয়, যার মধ্যে রয়েছে হত্যা মামলা এবং বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃথক মামলা।
বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও কারাভোগের অভিযোগ বহু বছর ধরেই উঠে এসেছে। জামিন পাওয়া সাবেক বিডিআর সদস্যদের স্বজনদের দাবি, অনেক নিরপরাধ সদস্যকে বিদ্রোহের সময় উপস্থিত না থাকার পরেও মামলায় জড়িয়ে বছরের পর বছর আটক রাখা হয়েছে। তারা দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির দাবি জানান।
আইনি বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের জামিন পাওয়া মামলার গতি প্রকৃতি ও রাষ্ট্রীয় নীতি বিশ্লেষণেও গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। দীর্ঘ ১৬ বছরের মধ্যে এটিই একবারে সর্বোচ্চ সংখ্যক জামিনপ্রাপ্তির ঘটনা বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
এদিকে জামিনপ্রাপ্ত সাবেক সদস্যদের অনেকেই মুক্তির পর সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে অবিচারের শিকার হয়েছি। জামিন পেয়ে আজ যেন নতুন করে বাঁচার সুযোগ পেলাম। এখন চাই, যেন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা থেকে চূড়ান্তভাবে মুক্তি মেলে।”
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কারা প্রশাসন, আইনজীবী মহল এবং সংশ্লিষ্ট মহলে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে বিচারের গতি ও প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে।
সরকারি আইনজীবীরা জানিয়েছেন, জামিনপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে মামলা এখনো চলমান। চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হবে এবং জামিনের শর্তাবলী মানতে হবে।
বিডিআর বিদ্রোহের মতো একটি জাতীয় নিরাপত্তা ও সামরিক শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী ঘটনার বিচার নিয়ে প্রায় দেড় দশক পরেও পূর্ণ নিষ্পত্তি না হওয়ায় মানবাধিকার সংগঠন ও বিচারপতি মহলে উদ্বেগ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
এই জামিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগকে আরও দায়িত্বশীল ও মানবিকভাবে মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ