
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকার কাকরাইল মোড় বৃহস্পতিবার (১৫ মে) সকাল থেকে কার্যত রূপ নিয়েছে ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা সকাল থেকেই ব্যারিকেড তৈরি করে মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা কাকরাইল মোড় থেকে যমুনা ভবনের দক্ষিণ পাশের সড়ক এবং মৎস্য ভবন অভিমুখী সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র যানজট ও জনদুর্ভোগ।
সারারাত অবস্থান করে সকালেও কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
বুধবার (১৪ মে) বিকেল থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন রাতভর চলেছে। প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন "যমুনা"র সামনে সারারাত ধরে শতাধিক শিক্ষার্থী থেকে যান, সেখানেই তারা খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করে রাত কাটান। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম রাতে উপস্থিত হয়ে কিছুটা আশ্বাস দিলেও তা ‘গা বাঁচানো’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা। আশ্বাসের বদলে শিক্ষার্থীরা চেয়েছেন একটি সময়বদ্ধ লিখিত প্রতিশ্রুতি।
বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম বলেন, “আমরা এখানে এসেছি আমাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলতে। রাত ২টা পর্যন্ত বসে থেকেছি, কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কেউ কথা বলতে আসেননি। মাহফুজ আলম আশ্বাস দিলেও আমরা তাকে বলেছি—এটি যথেষ্ট নয়।”
১১টায় যোগ দেবেন সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চলছে একাত্মতা ঘোষণা
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে অবস্থান কর্মসূচি নতুন গতি পায়। শিক্ষার্থীরা জানান, সকাল ১১টার পর সর্বস্তরের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ও ছাত্রসংগঠনগুলো একযোগে তাদের আন্দোলনে যুক্ত হবেন। ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার পরিষদ এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সদস্য সচিব শামসুল আরেফিন, ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হাসান এবং শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নৈতিক সমর্থন জানান। তারা বলেন, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন যৌক্তিক এবং দাবি পূরণ না হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি এটা হবে অবজ্ঞার প্রতিফলন।
শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের দমন-পীড়নের অভিযোগ
বুধবার দুপুরে শুরু হওয়া পদযাত্রায় শিক্ষার্থীরা হাজারো মানুষের সমাবেশ নিয়ে যমুনা ভবনের দিকে রওনা দিলে প্রথমে গুলিস্তানের মাজার গেটে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হন। বাধা উপেক্ষা করে তারা মৎস্য ভবন পর্যন্ত পৌঁছান। কিন্তু কাকরাইল মসজিদের মোড়ে পৌঁছাতেই পুলিশ অতর্কিতভাবে টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং জলকামান ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে।
এই অভিযানে অন্তত ১০০ জন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাংবাদিক আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে现场ে উপস্থিত আন্দোলনকারীরা। অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন, গুরুতর আহত কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে, যেখানে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর ‘বেপরোয়া দমন-পীড়ন’ চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তিন দফা দাবির বিস্তারিত
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তিনটি মূল দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন করছেন, যা তাঁরা ‘বাঁচা-মরার প্রশ্ন’ হিসেবে বিবেচনা করছেন:
১. আবাসন বৃত্তি কার্যকর করা:
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঢাকা শহরে ভাড়া বাসায় থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধার অভাবে তারা আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় তারা দাবি করেছে, যতদিন না পর্যন্ত আবাসন ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত করা যায়, ততদিন ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে অন্তত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন বৃত্তি চালু করতে হবে।
২. পূর্ণাঙ্গ বাজেট অনুমোদন:
বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি বছরের জন্য প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট থেকে বড় অঙ্কের বরাদ্দ কেটে নেওয়ার পরিকল্পনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, এই বাজেটের কাটছাঁট শিক্ষা কার্যক্রম, গবেষণা, শিক্ষা সহায়তা, আবাসন প্রকল্প ও বিভিন্ন জরুরি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই বাজেট কাটছাঁট না করে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পূর্ণরূপে অনুমোদনের দাবি জানানো হয়েছে।
৩. দ্বিতীয় ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন:
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা দিন দিন বাড়লেও একমাত্র ক্যাম্পাসটি সেই তুলনায় একেবারেই ছোট ও দুর্বল অবকাঠামোতে ঠাসা। ইতোমধ্যে ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাস’ নির্মাণের প্রস্তাব একাধিকবার উঠে এসেছে, কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়নের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, বিষয়টি পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে তা অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রশাসনের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি
আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আন্দোলন চলাকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন তারা।
এদিকে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে দাবি পূরণের কোনো আশ্বাস না পেলে শুক্রবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে লাগাতার অবরোধ, পদযাত্রা এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। “আমরা ক্লাসে ফিরব, কিন্তু আগে সরকারকে সমাধান নিয়ে আসতে হবে”—বলে জানান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এক শিক্ষার্থী।
জনজীবনে প্রভাব
কাকরাইল, মৎস্য ভবন, রাজমনি, বিজয়নগর, গুলিস্তান এলাকা ইতোমধ্যেই যানবাহন চলাচলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অফিসমুখী সময়েও যান চলাচল ব্যাহত হওয়ায় সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। ট্রাফিক পুলিশ বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা করলেও তা যথেষ্ট নয় বলে জানান এলাকাবাসী।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন যেন আরেকবার শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার প্রতিফলন তুলে ধরেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি দ্রুত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে এই আন্দোলন ঢাকার রাজপথকে আরও অচল করে দিতে পারে। ফলে এখনই সময়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল আচরণ করে ছাত্রদের ন্যায্য দাবিগুলোর সমাধান দেওয়ার। অন্যথায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে পারে জাতীয় পর্যায়ে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ