
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের ক্ষেত্রে অনন্য এক রেকর্ড গড়লেন ইকরামুল হাসান শাকিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হেঁটে সবচেয়ে কম সময়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করে গিনেস বিশ্বরেকর্ডে নিজের নাম লেখানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন তিনি।
বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার ইনানি সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র ৮৪ দিনের টানা পদযাত্রায় তিনি এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছেছেন। পথে তিনি অতিক্রম করেছেন প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার দুর্গম পথ, যা পদযাত্রার মাধ্যমে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শীর্ষে ওঠার বিশ্ব ইতিহাসে একক ও অভূতপূর্ব ঘটনা।
এই অবিশ্বাস্য কীর্তির কথা নিশ্চিত করেছেন অভিযানের সমন্বয়ক এবং বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (BMTC) সদস্য সাদিয়া সুলতানা শম্পা। তিনি জানিয়েছেন, শাকিল সফলভাবে এভারেস্টের চূড়া জয় করে বর্তমানে ক্যাম্প ৪-এ অবস্থান করছেন। যদিও এখনো তার সুনির্দিষ্ট আরোহণের সময় ও ফটো-ভিডিও হাতে আসেনি, তবে নেপালের এভারেস্ট পর্বতারোহণ পরিচালনাকারী কোম্পানি থেকে অভিযাত্রার সফলতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
শম্পা বলেন, "শাকিল দ্রুততম সময়ে সমুদ্র থেকে হেঁটে যাত্রা শুরু করে পাহাড় ডিঙিয়ে প্রায় ১৩শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সফলভাবে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছেছেন। যোগাযোগব্যবস্থা অচল থাকায় বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আমরা তার নিরাপদে বেসক্যাম্পে ফেরার জন্য উদ্বিগ্ন এবং অপেক্ষায় আছি।"
এই অভাবনীয় অর্জনের মধ্য দিয়ে শাকিল পেছনে ফেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত পর্বতারোহী টিম ম্যাকার্টনি-স্নেপকে। ১৯৯০ সালে ম্যাকার্টনি-স্নেপ ভারতের গঙ্গাসাগর থেকে যাত্রা শুরু করে ৯৬ দিনে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এভারেস্ট জয় করেছিলেন। শাকিল তার চেয়ে প্রায় ৭ দিন কম সময়ে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখেছেন।
২০২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের ইনানি সমুদ্র সৈকত থেকে ‘সি টু সামিট’ অভিযানের শুরু করেন শাকিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ৯০ দিনের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হেঁটে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছানো। যাত্রাপথে তিনি পাড়ি দেন বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপালের পাহাড়ি, বনভূমি ও পর্বতঘেরা দুর্গম অঞ্চল।
প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ কিমি পথ হেঁটে, পাহাড়ি নদী, খাড়া ঢাল, তুষারপাত ও শূন্যের নিচে তাপমাত্রার সঙ্গে লড়াই করে তিনি পৌঁছান ২৯,০৩১ ফুট উচ্চতার এভারেস্টের চূড়ায়।
এই কঠিন অভিযানে তাকে সহায়তা করেছে বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব। অভিযানের জন্য তিনি নিয়েছিলেন দীর্ঘ প্রস্তুতি, ফিজিক্যাল ট্রেনিং ও উচ্চমাত্রার পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ। ভারত থেকে পর্বতারোহণের আনুষ্ঠানিক কোর্স করে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন শাকিল।
ইকরামুল হাসান শাকিলের পর্বতারোহণে এই প্রথম অর্জন নয়। ২০১৩ সালে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় পায়ে হেঁটে ১১ দিনে পৌঁছে নজর কাড়েন। এরপর যোগ দেন বিএমটিসিতে। ২০১৫ সালে এম এ মুহিতের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাতজন অভিযাত্রী যখন প্রথমবারের মতো ২০,২৯০ ফুট উচ্চতার কেয়াজো-রি পর্বতশৃঙ্গ জয়ের অভিযান করেন, তখন তাদের একজন ছিলেন শাকিল।
শাকিলের আগে বাংলাদেশ থেকে এভারেস্ট জয়ের গৌরব অর্জন করেন মুসা ইব্রাহিম (২০১০), নিশাত মজুমদার (২০১২), এম এ মুহিত (২০১২), ওয়াসফিয়া নাজরীন (২০১২), খালেদ হোসেন (২০১৩) ও বাবার আলী (২০২৩)। শাকিল হলেন বাংলাদেশের সপ্তম এভারেস্টজয়ী, তবে তিনি একমাত্র যিনি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পদব্রজে গিয়ে এই চূড়া জয় করেছেন।
বর্তমানে ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট ফোন সংযোগ না থাকায় শাকিলের চূড়ান্ত অবস্থান ও অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা না গেলেও, অভিযানের সমন্বয়কারীরা আশা করছেন, খুব শিগগিরই তার জয়োৎসবের ভিডিও, ছবি ও বিস্তারিত আপডেট সবাইকে জানানো সম্ভব হবে।
ইতিমধ্যে “ইকরামুল হাসান শাকিল” নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার পেজে বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করা হচ্ছে, যেখানে আগ্রহীরা নিয়মিত আপডেট পেতে পারেন।
শুধু শারীরিক সক্ষমতা নয়, মানসিক দৃঢ়তা, অদম্য সাহস ও অগ্রযাত্রার অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবেন ইকরামুল হাসান শাকিল। তার এই অভিযান শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য গৌরবের মুহূর্ত, যা বিশ্ব পর্বতারোহণ ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
এই অসামান্য অর্জনের জন্য গোটা দেশ আজ তার জন্য গর্বিত এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তিনি সুস্থ-সবলভাবে ফিরে আসুন বেসক্যাম্পে এবং তার কীর্তির সব চিত্র পৌঁছাক সবার কাছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ