
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ধনীদের করের হার বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাবনা রয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের ওপর আয়কর চাপ বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে, দীর্ঘদিনের কর সুবিধা ভোগ করা ডেইরি, পোলট্রি ও মৎস্য খাতের করছাড় বাতিলের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। কর কাঠামোর এই পরিবর্তনগুলোর ফলে দেশের কর আদায় ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আসতে পারে, যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে আজ (রোববার) চূড়ান্ত হবে বলে জানা গেছে।
করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে, সাধারণ করদাতার জন্য সুখবর
বর্তমানে দেশে ব্যক্তিগত আয়ের করমুক্ত সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা হলেও, নতুন বাজেটে প্রতিটি কর স্লাব বাড়িয়ে মোট করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে। এর ফলে সাধারণ করদাতারা কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন। বর্তমানে ৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ধাপে ধাপে কর ধার্য করা হয়; তবে আগামী বাজেটে প্রতিটি কর স্লাব বৃদ্ধি পেলে আয়কর বোঝা কিছুটা কমে আসবে।
সর্বোচ্চ করহার বাড়ছে ৩০ শতাংশে
এখন পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত আয়কর হার ছিল ২৫ শতাংশ। তবে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরেই ধনী ব্যক্তিদের ওপর করহার বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে। গত কয়েক বছরের বাজেটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও নানা কারণে তা কার্যকর হয়নি। এবারই সরকার এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে। অর্থাৎ ধনীরা আগামী বাজেটে আগের চেয়ে বেশি কর দিতে বাধ্য হবেন।
ন্যূনতম কর বাড়ছে, সব এলাকায় সমতা আসছে
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ন্যূনতম করের হার ভিন্ন। ঢাকা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা, অন্য সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪ হাজার টাকা এবং সিটি করপোরেশনের বাইরে ৩ হাজার টাকা। নতুন বাজেটে এই পার্থক্য বাতিল করে দেশের সব জায়গায় ন্যূনতম করের হার ৫ হাজার টাকা করার সম্ভাবনা রয়েছে, যা কর ব্যবস্থায় সমতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ডেইরি, পোলট্রি ও মৎস্য খাতে করছাড় বাতিল
দেশের ডেইরি, পোলট্রি এবং মৎস্য খাত দীর্ঘদিন ধরেই করছাড় ভোগ করে আসছে, যেখানে সর্বোচ্চ করহার মাত্র ১৫ শতাংশ। এই করছাড়ের সুযোগে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেকে মৎস্য খাতের উদ্যোক্তা সেজে কর কম দিয়ে নিজেদের আয়ের পরিমাণ হ্রাস করে দেখান। এই ধরনের কর ফাঁকি প্রতিরোধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে চলেছে এবং আগামী বাজেটে এসব খাতে করছাড় তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রাখছে। এর ফলে এই খাতগুলো থেকে আয়কর আদায় সাধারণ ব্যক্তিদের করহার মতো ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
কালো টাকা সাদা করায় কর বাড়ছে
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এতে ব্যক্তিবিশেষ এবং প্রতিষ্ঠান তাদের গোপন সম্পদ বৈধ করতে পেরেছেন। তবে বর্তমান সরকার ওই সুযোগ বাতিল করে দিয়েছে। শুধু বাড়ি ও ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে এই সুবিধা সীমিত পরিমাণে বজায় থাকবে, তবে সেখানে করের হার বাড়ানো হবে। ফলে ভবিষ্যতে কেউ কালো টাকা সাদা করতে গেলে আরও বেশি কর দিতে হবে।
টার্নওভার কর দ্বিগুণ বাড়তে পারে
অন্যদিকে, ব্যবসায় টার্নওভার কর প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। বর্তমানে বছরে ৩ কোটি টাকার বেশি টার্নওভার সম্পন্ন ব্যবসাগুলোর ওপর ০.৬ শতাংশ ন্যূনতম কর ধার্য করা হয়। আগামী বাজেটে এটি বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। মোবাইল অপারেটর, সিগারেট ও তামাক প্রস্তুতকারকদের ন্যূনতম কর আগের মতোই থাকবে। ব্যবসায় লোকসান হলেও টার্নওভার কর দিতে হয়, যা ব্যবসায়ীদের জন্য এক ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত।
করপোরেট কর ছাড় শিথিলের সম্ভাবনা
করপোরেট কর ছাড়ের জন্য আরোপিত নগদ লেনদেনের শর্ত শিথিল করার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে নগদ লেনদেন কমানোর উদ্দেশ্যে শর্ত দেওয়া হয়, যাতে কম্পানিগুলোকে সব ধরনের আয়ের ব্যাংক ট্রান্সফার করতে হয়। বর্তমানে নগদ লেনদেনের সীমা বাড়ানো হয়েছে ব্যবসায়ীদের চাপে। ভবিষ্যতে শর্ত শিথিল হলে করপোরেট করের হার বজায় রেখে কর আদায় সহজ হতে পারে।
অ্যাসেসমেন্টের বিধান ফিরতে পারে
করদাতাদের হয়রানি কমানোর জন্য গত অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের বিধান বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু এই কারণে কর আদায়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই আগামী বাজেটে এই বিধান পুনরায় চালু করার সম্ভাবনা রয়েছে, যাতে আয়কর আদায় প্রক্রিয়া আরো কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য হয়।
এই কর সংস্কারগুলো সরকারের আয়ের ভাণ্ডার জোরদারের পাশাপাশি ব্যবসায় পরিবেশ ও কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে নেওয়া হয়েছে। কর ব্যবস্থার এই পরিবর্তন সাধারণ মানুষের ওপর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কর ফাঁকি ও কালো টাকার প্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী বাজেট ঘোষণার পর এই পরিবর্তনগুলো বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হলে করদাতারা তাদের আর্থিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাও তদনুযায়ী সাজাতে পারবেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ