
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের দ্রুত বৃদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি হালনাগাদ প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে খেলাপি ঋণের হার আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে, যা বিগত এক দশকে সর্বোচ্চ। গত বছরের ডিসেম্বরেও এই হার ছিল ৯ শতাংশের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঊর্ধ্বগতি যদি রোধ করা না যায়, তাহলে তা ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. জমশেদ আলী চৌধুরী বলেন, “গত সরকারের আমলে অনেক ব্যাংকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ অনুমোদনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জামানত, ব্যবসায়িক সক্ষমতা বা ঋণ পরিশোধের ইতিহাস যাচাই না করেই মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “যারা লুটপাট করে বিদেশে পালিয়েছে, তাদের ঋণ এখন আদায় অযোগ্য। এসবই খেলাপি হয়ে যাচ্ছে এবং এটি ব্যাংকিং খাতকে অচল করে দিতে পারে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ (প্রয়াত) বহু আগেই এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন যে, “ব্যাংক থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফিরছে না। ব্যাংকের আর্থিক ভারসাম্য ভেঙে পড়তে বেশি সময় লাগবে না।”
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি খেলাপি হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ। দীর্ঘমেয়াদি যেসব ঋণের গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে, সেগুলোর মেয়াদ শেষ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে। বিশেষ করে নির্মাণ, রপ্তানি এবং গার্মেন্ট খাতে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগুলো এখনো খেলাপি হয়নি, কিন্তু সময় মতো পরিশোধ না হলে সেগুলোরও একই পরিণতি হবে।
বিপুল অঙ্কের এসব ঋণ আদায় অনিশ্চিত বলেই মনে করেন ব্যাংক বিশ্লেষক মাহবুব হাসান: “বর্তমানে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে যে পরিমাণ প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে, তাতে খেলাপি ঋণ আর বাড়লে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।”
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো ঋণ তিন মাসের মধ্যে কিস্তি পরিশোধ না হলে সেটি খেলাপি বলে বিবেচিত হয়। আগে বাংলাদেশে এই সময়সীমা ছিল ছয় থেকে নয় মাস। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মানদণ্ড কার্যকর করেছে ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে। এর ফলে জুন প্রান্তিকে খেলাপির হার আরও বাড়বে বলে নিশ্চিত করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. আজিজুল হক জানান, “আমরা আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করছি যাতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বাড়ে। তবে ব্যবসায়ীরা যে এর কার্যকারিতা পিছিয়ে দিতে বলছেন, সেটিও বিবেচনায় আছে। কিন্তু আইএমএফের চাপ থাকায় এখনই তা স্থগিত করা যাচ্ছে না।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যেসব ঋণের অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়েছে, সেগুলো আদায় করা প্রায় অসম্ভব। তবে আন্তর্জাতিক সহায়তায় অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ চলছে। এর মধ্যে ইন্টারপোলের সহায়তায় কয়েকজন বড় ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের কয়েকটি ব্যাংক ইতিমধ্যে খেলাপিদের সম্পত্তি নিলামে তুলেছে। এতে কিছুটা অর্থ আদায় হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এর প্রভাব খুবই সামান্য।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (BIBM) সাবেক অধ্যাপক ড. শাহজাহান মিয়া বলেন, “যে অর্থ পাচার হয়েছে তা শুধু ব্যাংকের ক্ষতি নয়, পুরো অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত। এর ফলে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, কর্মসংস্থান কমছে এবং ব্যাংকের প্রতি জনগণের আস্থা কমছে।”
যেসব গ্রাহক ব্যবসা চালিয়ে যেতে চান, তাদের জন্য খেলাপি ঋণ নবায়নের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তবে যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই বিশেষ পরিদর্শন টিম পাঠিয়ে সম্পদের অবস্থা যাচাই করছে। তাছাড়া আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (FIU) ও দুদকও যুক্ত হয়েছে খেলাপি ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়ায়।
বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘গভীর সংকেত’ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন এই ঝুঁকি মোকাবিলায় কঠোর আইন প্রয়োগ, দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং খেলাপি ঋণের জন্য অনুকূল নীতি বাতিল করা এখন সময়ের দাবি।
অর্থনীতিবিদ ড. নাজমুল হক বলেন, “এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু খেলাপি সংস্কৃতি। এটি যদি থামানো না যায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ তো দুরের কথা, দেশীয় উদ্যোক্তারাও ব্যাংকিং খাতে আস্থা হারাবে।”
পরিশেষে বলা যায়, খেলাপি ঋণ সমস্যা এখন আর শুধু আর্থিক নয়, এটি একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট। এর সমাধানে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা এবং কঠোর নজরদারি। না হলে খুব দ্রুতই ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা গোটা দেশের অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে তুলবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ