
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ এখন আর বাংলাদেশে স্বীকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন করতে পারবে না, এমন স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ। দলটির নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক স্থগিত থাকায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে দলটির সবধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। নিবন্ধনের স্থগিতাদেশ বাতিল বা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কোনো জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলেও তিনি জোর দিয়ে উল্লেখ করেন।
সোমবার (১৯ মে) সকালে রাজশাহী আঞ্চলিক লোক প্রশাসন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় এই বক্তব্য দেন তিনি। নির্বাচন কমিশনের আয়োজনে ‘ভোটার তালিকা হালনাগাদ-২০২৫, পরবর্তী পর্যালোচনা ও টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা’ শীর্ষক ওই কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই ঘোষণা দেন।
ইসি মাছউদ বলেন, “সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন স্থগিত রেখেছে। এই নিবন্ধনের স্থগিতাদেশ যদি প্রত্যাহার বা বাতিল না করা হয়, তাহলে দলটির পক্ষে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। কমিশনের দিক থেকে তাদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগই আপাতত নেই।”
তিনি আরও বলেন, “এটা একটি প্রশাসনিক এবং সাংবিধানিক বিষয়। নির্বাচন কমিশন আইনি কাঠামোর বাইরে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি ছাড়া কোনো সংগঠনকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়।”
কর্মশালায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্ন ছিল—আওয়ামী লীগ ছাড়া একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব কি না? এ প্রশ্নের জবাবে ইসি মাছউদ বলেন, “এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো নির্বাচন আয়োজন করা। প্রধান উপদেষ্টা (বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান) যে সময় নির্ধারণ করে দেবেন, সে সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য কমিশন সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে।”
তার এই বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কমিশন রাজনৈতিক বাস্তবতার চেয়ে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অর্থাৎ, কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে কি না, সে বিষয়টি কমিশনের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, বরং নিবন্ধন ও আইনগত বৈধতা অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন করাই কমিশনের দায়িত্ব।
সোমবারের কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। এছাড়া রাজশাহীর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ, রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি, জেলা প্রশাসক এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
কর্মশালায় মূলত ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন, জবাবদিহি এবং টেকসই পরিকল্পনা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাজনৈতিক বাস্তবতা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ অবস্থা এবং তার প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের করণীয়।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত একটি তদন্ত প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় সরকার দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। সেইসঙ্গে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন ‘স্থগিত’ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন বাতিল করা হয়নি, তবে বর্তমান স্থগিতাবস্থায় দলটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে কিংবা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। প্রায় সাত দশকের পুরনো ও দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রাখা দেশের গণতন্ত্রের গতিপথে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও নিবন্ধন স্থগিতাদেশ দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের বিভক্তি ও অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে। এতে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি, প্রচারণা ও সাংগঠনিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদের বক্তব্য স্পষ্ট করেছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। নিবন্ধন ও রাজনৈতিক বৈধতা ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত এই দলটির রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের ঘোষণায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন চাপ বাড়ছে, তেমনি আগামী নির্বাচনের কাঠামো ও বৈধতা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ