
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলাগুলো নিয়ে অবশেষে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে সারাদেশে যে সব রাজনৈতিক মামলায় ন্যায্য বিচার বা নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়াই বিরোধীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ উঠেছিল, সেগুলোর একটি বড় অংশ এখন প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন-১ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে ১০ হাজার ৫০৬টি মামলাকে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বলে চিহ্নিত করে সেগুলো প্রত্যাহারের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে মামলা নম্বর উল্লেখ করে পাবলিক প্রসিকিউটরদের পরামর্শ প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ কার্যক্রমে দুটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে—একটি জেলা পর্যায়ে এবং অন্যটি কেন্দ্রীয় বা মন্ত্রণালয় পর্যায়ে। জেলা কমিটির সভাপতি থাকছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সদস্যসচিব অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সদস্য হিসেবে পুলিশ সুপার এবং জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (মহানগরে মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর)।
জেলা কমিটির মূল্যায়নের ভিত্তিতে কোনো মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হয়রানিমূলক হলে তারা সেটিকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করবে। সেই সুপারিশ, মামলার এজাহার, অভিযোগপত্রসহ অন্যান্য তথ্য ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে।
মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সুপারিশপ্রাপ্ত মামলাগুলো যাচাই করে একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব মামলা প্রত্যাহারের জন্য আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে। পুরো প্রক্রিয়া চলে তিন স্তরে—জেলা পর্যায়ে শনাক্তকরণ, মন্ত্রণালয় পর্যায়ে যাচাই এবং আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং।
মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন খ্যাতিমান সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জননিরাপত্তা বিভাগের আইন-১ শাখার একজন সিনিয়র সহকারী সচিব। এই কমিটিতে আরও রয়েছেন জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, অতিরিক্ত সচিব (আইন ও শৃঙ্খলা), যুগ্ম সচিব (আইন) এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব।
প্রত্যাহারের জন্য মামলার ভুক্তভোগীরা ব্যক্তিগতভাবেও আবেদন করতে পারবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বা আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটরের কাছে আবেদন জানানো যাবে। আবেদনকারীকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রের সত্যায়িত অনুলিপি জমা দিতে হবে।
এসব আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে তালিকা তৈরি করে তা আবার মন্ত্রণালয়ের কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। কমিটির বৈঠকে রেজুলেশন আকারে অনুমোদনের পর তা আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন আসার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর চিঠি পাঠায়, যার ভিত্তিতে মামলা প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর মানিকগঞ্জে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একটি নাশকতার মামলা করা হয়। মামলায় অভিযোগ ছিল, তারা ককটেল বিস্ফোরণের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছেন। ওই মামলায় জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ পারভেজ ও ছাত্রদলের কর্মী জসিম উদ্দিন ওরফে আকাশকে রাতে গ্রেপ্তার করা হয়।
জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা এই মামলাকে “গায়েবি ও হয়রানিমূলক” বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ বানচাল করতে সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গায়েবি মামলা দায়ের করে নেতাকর্মীদের আটক করে।”
মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এসএ জিন্নাহ কবির জানান, “শুধু আমার নামেই আগের সরকার আমলে ৩৩টি হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছিল। এমন অসংখ্য ঘটনা সারাদেশে ঘটেছে।”
তবে উল্লেখযোগ্য যে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনের আওতায় দায়েরকৃত মামলাগুলো প্রত্যাহার করা যাচ্ছে না সহজেই। এসব মামলায় ১৯৫৪ সালের দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের ১০(৪) ধারার অধীনে কমিশনের লিখিত অনুমতি প্রয়োজন। তাই এই মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সল হাসান বলেন, “নিরপরাধ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনর্থক হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এই কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ যদি নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তবে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে গায়েবি মামলা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা গ্রেপ্তার ও পুলিশি হয়রানি দেশজুড়ে আতঙ্ক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করেছে।
এই উদ্যোগ রাজনৈতিক সমঝোতা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষার পথে একটি সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, এই উদ্যোগ কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায় এবং সত্যিকার অর্থে নিরপরাধ মানুষরা এতে কতটা উপকৃত হন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ