
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর এবার সেই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৪ দলীয় জোটের অন্যান্য শরিকদের বিরুদ্ধেও একই রকম ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে। এক ব্যক্তি আদালতের শরণাপন্ন হয়ে নির্বাচন কমিশনসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মহলে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এ জোটের শরিক দলগুলোকেও "সন্ত্রাসী সংগঠন" হিসেবে ঘোষণা করে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।
এই আইনি নোটিশটি পাঠিয়েছেন হোসাইন মো. আনোয়ার নামে একজন নাগরিক, যিনি নিজেকে লক্ষ্মীপুর জেলার বাসিন্দা এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর পক্ষে আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগান রোববার (১৮ মে) এই নোটিশটি পাঠান। নোটিশের কপি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছাড়াও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়, যেহেতু সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গুম, খুন, ধর্ষণসহ নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে, সেই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যান্য শরিক দলগুলোর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ খাটে। অতএব, এসব দলের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই এবং তাদের বিরুদ্ধেও কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় রাজনৈতিক জোটের সদস্য দলগুলো হলো:
জাতীয় পার্টি (এরশাদ)
জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
গণতন্ত্রী পার্টি
গণ আজাদী লীগ
বাসদ (রেজাউর)
সাম্যবাদী দল (দিলীপ বড়ুয়া)
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর)
গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি
জাসদ (ইনু)
শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল
বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট কেন্দ্র
নোটিশে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থেকে এই দলগুলোও গত ১৫ বছরে দেশে সন্ত্রাস, দমন-পীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনে সহায়তাকারী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। তারা সরকারের বিভিন্ন দমনমূলক কর্মসূচিকে সমর্থন ও বৈধতা দিয়েছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণও করেছে। তাই তাদের কার্যক্রমও "সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯" অনুযায়ী নিষিদ্ধ করা উচিত।
গত ১২ মে সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। সরকার দাবি করে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর নিপীড়নমূলক দমন-পীড়ন চালিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে গুম, খুন, ধর্ষণ, বেআইনি আটক, অগ্নিসংযোগ, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ রাষ্ট্রবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যা দেশি-বিদেশি প্রতিবেদনে প্রমাণিত।
বিশেষভাবে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দমন করতে গিয়ে যে সহিংসতা ও গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে, তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের আওতায় পড়ে। সরকার দাবি করে, আওয়ামী লীগের এসব কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব, সংহতি, জননিরাপত্তা, বিচারিক স্বচ্ছতা এবং সাংবিধানিক শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আওয়ামী লীগ এবং এর নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড, রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা—সবকিছুই নিষিদ্ধ ঘোষণার আওতায় পড়বে। সরকারের মতে, যতদিন পর্যন্ত না আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা নিষ্পত্তি হয়, ততদিন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের রাজনৈতিক কর্মসূচি, গণমাধ্যমে প্রচার, সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল এবং সমস্ত প্রচারণা নিষিদ্ধ থাকবে।
সরকারি এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলেও ১৪ দলীয় শরিকরা কীভাবে রাজনীতি চালাতে পারবে? তাদের অনেকেই সংসদে, সরকারে বা বিভিন্ন প্রশাসনিক উপদেষ্টা কমিটিতে ভূমিকা রেখেছেন। এখন তাদের বিরুদ্ধে যদি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে পুরো জোটের রাজনৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়বে।
আইনি নোটিশদাতা এই দাবিকেই সামনে টেনে নির্বাচন কমিশনকে চাপ দিচ্ছেন যেন তারা জোটের অন্যান্য দলগুলোর নিবন্ধনও পর্যালোচনা করে এবং যথাযথ আইন প্রয়োগ করে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি সরকার এই দাবিকে আমলে নেয়, তাহলে ১৪ দলীয় জোট পুরোপুরি বিলুপ্তির পথে যেতে পারে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস ঘটতে পারে। এতে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঐতিহ্যবাহী জোট হিসেবে পরিচিত দলগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, অন্যদিকে নতুন রাজনৈতিক অক্ষরেখার জন্ম হতে পারে।
তবে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নজির, সংবিধানের মৌলিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি—সবকিছুকে বিচার করতে হবে। নচেত এটি ভবিষ্যতে আইনি ও রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত সিদ্ধান্তে পরিণত হতে পারে।
এখন দেখার বিষয়, নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো এই আইনি নোটিশের প্রেক্ষিতে কী ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ