
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে নতুন করে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ভারতের হঠাৎ করে আরোপিত এক নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিকসহ অন্তত সাত ধরনের পণ্য এখন থেকে আর স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। ভারতের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পরদিন থেকেই বাংলাদেশের সীমান্তে বিপুল পরিমাণ পণ্য আটকে যায়, যা রপ্তানিকারকদের জন্য এক ধরণের বিপর্যয়ের শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের অন্যতম প্রধান বাজার, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল—যেটি ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত—সেখানে পণ্য পাঠানো কার্যত অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলে এতদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, মৌলভীবাজারের চাতলাপুর, সিলেটের শেওলা ও তামাবিলসহ ছয়টি স্থলবন্দরের মাধ্যমে সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে পণ্য পাঠানো হতো। এখন সেই সব স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানির পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারকরা বাধ্য হচ্ছেন বিকল্প ও অনেক ব্যয়সাপেক্ষ সমুদ্রপথ বেছে নিতে।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে রপ্তানি খরচ পাঁচগুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। আগে যেখানে একটি ২০ ফুটের কার্গো ট্রাক ১৮ থেকে ২৫ হাজার টাকায় গন্তব্যে পৌঁছে যেত, সেখানে এখন সেই একই পরিমাণ পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত নিতে হবে এই একই খরচে, এরপর জাহাজে কলকাতার হলদিয়া বন্দর, সেখান থেকে আবার পণ্য নিতে হবে আসাম, মেঘালয়, করিমগঞ্জ বা আগরতলায়—যার জন্য বাড়তি এক লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে শুধু পরিবহনে। সময় লাগবে কমপক্ষে এক সপ্তাহ, যেখানে স্থলপথে এসব গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগত মাত্র একদিন।
বিশ্লেষক ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, ভারতের এই পদক্ষেপ ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হ্রাস করার কৌশল হতে পারে। ড্যানিশ ফুডের হেড অব বিজনেস দেবাশীষ সিংহ বলেন, “মূলত সেভেন সিস্টার্সের বাজারে ভারতের নিজস্ব পণ্যের চেয়ে বাংলাদেশের পণ্যের আধিক্য ছিল। কারণ ভারতের মূল ভূখণ্ডের কোম্পানিগুলোর চেয়ে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো কম খরচে সেখানে পণ্য পৌঁছাতে পারতো। সেই সুযোগ বন্ধ করার জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।”
তিনি আরও বলেন, “স্থলপথে আমরা দ্রুত, কম খরচে এবং কার্যকরভাবে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে পণ্য পাঠাতে পারতাম। এখন নৌপথে যেতে হলে কয়েকগুণ খরচ বাড়বে, সময়ও বাড়বে। পাশাপাশি একাধিকবার পরিবহন পরিবর্তনের ঝামেলা এবং পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।”
নিষেধাজ্ঞার বাস্তব প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। ভারতের বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কোমল পানীয় রপ্তানি করা আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড জানায়, তারা ভারতে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতকৃত পণ্য উৎপাদন স্থগিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব মার্কেটিং মাইদুল ইসলাম বলেন, “আমরা বছরে চার থেকে পাঁচ লাখ কার্টন কোমল পানীয় রপ্তানি করতাম ভারতে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন এই রপ্তানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে আজকেই আমরা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “এই সিদ্ধান্তে শুধু বাংলাদেশি কোম্পানিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, ভারতের ভোক্তারাও কম দামে ভালো মানের পণ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। আমাদের আশাবাদ, দুই দেশের সরকার আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করবে।”
বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি সামিম আহমেদ জানান, স্থলবন্দর বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিকারকরা। তিনি বলেন, “দেশ থেকে প্রায় ৫০টির বেশি কোম্পানি শুধু প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি করতো ভারতের সেভেন সিস্টার্সে। স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ হলে এই কোম্পানিগুলোর রপ্তানি কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে। সমুদ্রপথে গিয়ে অতিরিক্ত খরচের কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কখনোই সমুদ্রপথ ব্যবহার করিনি। খরচ বেড়ে যাওয়ায় ওই পথে পণ্য পাঠালে আর লাভ থাকবে না। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হতে পারে।”
এতদিন বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির অন্যতম শক্তিশালী ক্ষেত্র ছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। কম সময় ও খরচে পণ্য পৌঁছানোর সুযোগ থাকায় অনেক নতুন কোম্পানিও এ বাজারমুখী হয়েছিল। হঠাৎ করে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে শুধু পণ্য আটকে যাওয়াই নয়, শত শত কোটি টাকার অর্ডার ও কর্মসংস্থান ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা শুধু দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্কেই প্রভাব ফেলবে না, বরং আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, যদি দ্রুত কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ভারতের অন্য বাজারেও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ব্যবসায়ীরা একযোগে ভারত ও বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, দ্রুত এ সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হোক। তারা মনে করেন, এই নিষেধাজ্ঞা শুধু দুই দেশের ব্যবসার ক্ষতি নয়, বরং আঞ্চলিক বন্ধুত্ব ও অর্থনৈতিক সহাবস্থানেরও পরিপন্থী।
আশা করা হচ্ছে, ভারতের এই নিষেধাজ্ঞা সাময়িক এবং আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তবে যত দিন এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে, বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের ক্ষতি দিন দিন বাড়তেই থাকবে—যা সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ