
ছবি: সংগৃহীত
‘জুলাই বিপ্লব’ নামে পরিচিত বহুল আলোচিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে দায়ের করা মারধর ও হত্যাচেষ্টার মামলায় আওয়ামী লীগ সমর্থক ৬১ জন আইনজীবীর জামিন স্থগিতাদেশ বহাল রেখেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ। সোমবার (১৯ মে) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ এই আদেশ দেন। বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, হাইকোর্ট যে জামিন দিয়েছিল, তা আপাতত বলবৎ থাকবে না। পাশাপাশি হাইকোর্টে জারি করা রুল দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দুই সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়েছে আদালত।
এর আগে ২৯ এপ্রিল হাইকোর্ট ৬১ জন আইনজীবীকে জামিন দিলে তা চ্যালেঞ্জ করে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন জানায়। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে ৫ মে পর্যন্ত জামিন স্থগিত করে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক সেই স্থগিতাদেশ দেন এবং বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সর্বশেষ সোমবার আপিল বিভাগ সেই জামিন স্থগিতাদেশই বহাল রেখে হাইকোর্টকে নির্দেশ দিয়েছে রুল নিষ্পত্তি করতে।
মামলাটির সূত্রপাত ঘটে ঢাকায় আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। গত এপ্রিলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগপন্থি ও বিরোধীদল বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। নির্বাচনের পরদিনই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আদালত প্রাঙ্গণে সংঘর্ষ, ভাঙচুর এবং জীবননাশের হুমকি ও হামলার ঘটনায় আইনজীবীসহ সাধারণ লোকজন আহত হন। ঘটনাটি তখনই সারাদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
এই ঘটনার জেরে ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে পরিচিত একটি মামলার আওতায় মারধর, হত্যাচেষ্টা ও নাশকতার অভিযোগে মোট ৬১ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার তদন্ত চলাকালেই ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন ৬ এপ্রিল আসামিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর তারা জামিন চাইলে হাইকোর্ট তা মঞ্জুর করেন, যা পরবর্তীতে আপিল বিভাগে চ্যালেঞ্জ হয়।
বর্তমানে হাইকোর্টে যে রুল জারি রয়েছে, তার মধ্যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে—আসামিদের জামিন কেন বাতিল করা হবে না বা জামিন আদেশটি বহাল থাকবে কি না। আপিল বিভাগ হাইকোর্টকে বলেছে, এই রুল আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। অর্থাৎ আগামী ১৪ দিনের মধ্যেই হাইকোর্টকে কারণ দর্শাতে হবে কেন এই ৬১ জন আইনজীবীর জামিন বহাল থাকবে না।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আপিল বিভাগের এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি মামলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না, বরং ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলভিত্তিক আইনজীবীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও বিচারপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়ে এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বিশেষ করে আদালত প্রাঙ্গণে সংঘর্ষ বা সহিংসতার ঘটনায় আদালতের নিজস্ব শৃঙ্খলা রক্ষার প্রেক্ষাপটেও এটি গুরুত্বপূর্ণ নজির।
এই আদেশকে কেন্দ্র করে আইনজীবী মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা এটিকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল’ বলে দাবি করলেও বিরোধীপন্থি আইনজীবীরা আদালতের সিদ্ধান্তকে ন্যায়বিচারের পথে একটি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, আদালতের চত্বরে রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা এখন কেবল আইনজীবীদের নিরাপত্তার বিষয় নয়, এটি বিচার বিভাগের সার্বিক স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
আদালতের ভাষ্যমতে, বিচার বিভাগের পবিত্রতা রক্ষা করতে হলে আইনজীবী সমাজের মধ্যেই শৃঙ্খলা ও আইন মেনে চলার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি দলের প্রতি আনুগত্যের নামে বিচারালয়ে সহিংসতা, বিচার কাজে বাধা এবং সহকর্মী আইনজীবীদের ওপর হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এ আদেশের ফলে সংশ্লিষ্ট ৬১ জন আইনজীবী আপাতত জামিনে মুক্ত থাকতে পারবেন না, এবং তাদের মামলা সংক্রান্ত বিষয় হাইকোর্টে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নিষ্পন্ন হবে।
সার্বিকভাবে, আদালতের এই সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগের দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা রক্ষা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারপ্রক্রিয়ার বার্তা দিয়েছে বলে মনে করছেন আইনি বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ