
ছবি: সংগৃহীত
দেশে বেকারত্ব পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছাচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর প্রান্তিক পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৩০ হাজারে। যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগ পরিবেশ ও চাকরির বাজারের সংকোচনের একটি পরিষ্কার প্রতিচ্ছবি। এই হিসাব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গতকাল রোববার প্রকাশিত ‘ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ’-এ তুলে ধরেছে।
এই নতুন তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশ উচ্চ। গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরে এই হার ছিল ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ, এক বছরে বেকারত্ব বেড়েছে ০.৬৮ শতাংশ পয়েন্ট। এটি বিবিএস-এর ১৯তম আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যান সম্মেলন (ICLS) অনুযায়ী করা প্রাক্কলনের ভিত্তিতে পাওয়া ফলাফল।
উল্লেখ্য, এর আগে বাংলাদেশে শ্রমশক্তি জরিপ পরিচালনায় ILO-এর ১৩তম গাইডলাইন অনুসরণ করা হতো, যেখানে কর্মে নিয়োজিত হিসেবে এমন ব্যক্তিদের গণ্য করা হতো যারা বিগত সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা অর্থনৈতিক কাজ করেছেন, তা সে পণ্য উৎপাদনের জন্যই হোক বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। তবে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং সময়োপযোগী হওয়ার প্রয়োজনে বিবিএস এখন থেকে ILO-এর সর্বশেষ ১৯তম গাইডলাইন অনুযায়ীও পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে।
দুইটি গাইডলাইনের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৩তম ICLS অনুযায়ী ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং মোট বেকার সংখ্যা ২৬ লাখ ১০ হাজার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে; ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার এবং বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ২০ শতাংশ।
অপরদিকে, ১৯তম গাইডলাইন অনুযায়ী বর্তমানে দেশের বেকার সংখ্যা ২৭ লাখ ৩০ হাজার। এক বছর আগে এই সংখ্যাটি ছিল ২৪ লাখ। অর্থাৎ, নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ীও দেশে এক বছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার নতুন বেকার জনশক্তি যুক্ত হয়েছে।
এই ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, শিল্প ও ব্যবসা খাতে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা এবং ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার বেকারত্ব বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম মূল চালক হিসেবে কাজ করেছে।
বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠী, যাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, তাদের বড় একটি অংশ চাকরির সুযোগ না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। তদুপরি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রপ্তানিমুখী খাতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় নিয়োগও সীমিত হয়ে পড়েছে। সরকারের বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পেও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কম দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে বিবিএস ১৯তম ICLS-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী জরিপ পরিচালনা শুরু করেছে, যেখানে বেকার হিসেবে বিবেচিত হন তারা, যারা গত ৭ দিনে কোনো কাজ করেননি এবং আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজ শুরু করতে প্রস্তুত, এবং গত ৩০ দিনে সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজেছেন।
অন্যদিকে, ১৩তম ICLS অনুসারে এমন ব্যক্তিকেও কর্মে নিয়োজিত হিসেবে ধরা হয়, যিনি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে হলেও অন্তত এক ঘণ্টা কাজ করেছেন। এর ফলে একই সময়ের জন্য দুই ধরনের গাইডলাইনে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান দেখা যায়।
বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুসারে, যারা বিগত সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে বা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনমূলক কাজ করেছেন, তাদেরকেই কর্মে নিয়োজিত ধরা হয়। আর যাঁরা গত সাত দিনে কোনো কাজ করেননি, তবে কর্মক্ষম ও আগ্রহী ছিলেন, তাঁদের ধরা হয় বেকার হিসেবে।
এই সংজ্ঞাগত পরিবর্তনের কারণে দেশের প্রকৃত বেকারত্বের চিত্র আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে বলে মত বিশ্লেষকদের। কারণ পূর্ববর্তী হিসাবে অনেক 'আংশিক কর্মসংস্থানে নিয়োজিত' ব্যক্তিও 'চাকরিজীবী' হিসেবে বিবেচিত হতেন, যা বাস্তবচিত্র থেকে অনেকটা দূরে ছিল।
অর্থনীতিবিদ ও শ্রম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শ্রমবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুদহার হ্রাস, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে অর্থায়ন, কারিগরি ও প্রযুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষণ বাড়ানো এবং সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তারা আরও বলছেন, দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী যদি টেকসই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হয়, তবে তা শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই নয়, সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নকেও হুমকির মুখে ফেলবে।
সাম্প্রতিক এই শ্রমশক্তি জরিপ বাংলাদেশের শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী চিত্র তুলে ধরেছে। তবে একইসঙ্গে এটি দেশকে একটি সতর্ক বার্তাও দিচ্ছে—যেখানে বেকারত্বের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে এবং কার্যকর কর্মসংস্থান তৈরি ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। দেশের স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য নীতিনির্ধারকদের এখনই এই সংকট মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ