
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-তে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে দেশের ১০টি মেগা প্রকল্পে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পগুলোর জন্য মোট বরাদ্দ কমছে ৬ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ ১০টি প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩৪ হাজার ৮১০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, যা সংশোধিত এডিপিতে কমিয়ে ৩০ হাজার ৫০৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা করা হয়। আগামী অর্থবছরের জন্য এই বরাদ্দ আরও কমিয়ে রাখা হয়েছে ২৮ হাজার ৩৮৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরের পরিকল্পনায় বরাদ্দ কমেছে যথাক্রমে ৬ হাজার ৪২৩ কোটি এবং সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছেন, অনেক প্রকল্পের নকশা ও বাস্তবায়ন কৌশলে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এর ফলে অর্থায়নও নতুন করে হিসাব করে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কিছু প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চললেও অপচয় রোধে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় প্রকল্পগুলো ঘিরে নতুন নিরাপত্তা ও অবকাঠামো প্রকল্প নেওয়ায় মূল প্রকল্পের ব্যয় সামান্য কমানো হয়েছে।
প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দ হ্রাস ও বৃদ্ধি:
১. রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ২২২ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা, যা সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ১০ হাজার ১১ কোটি টাকা। মূল বরাদ্দ থেকে কমেছে ৪৯১ কোটি টাকা। তবে এখন পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
২. মাতারবাড়ী আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ প্রকল্প: মোট ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ২০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যেখানে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক অর্থবছরেই বরাদ্দ কমছে প্রায় ৫ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। এতদিনে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
৩. ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (মেট্রোরেল লাইন-৬): মোট ব্যয় ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা হলেও, আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে রাখা হচ্ছে ১ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। পূর্ববর্তী এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ কমেছে ৬২৮ কোটি টাকা।
৪. মেট্রোরেল লাইন-১: এই প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা, যা সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ হচ্ছে ৮ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা—অর্থাৎ বরাদ্দ বেড়েছে ৫ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা।
৫. মেট্রোরেল লাইন-৫ (নর্দার্ন রুট): বরাদ্দ বাড়ছে ৫২২ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৪৯০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, যেখানে চলতি বছরের বরাদ্দ ছিল ৯৬৮ কোটি টাকা।
৬. সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (পিপিপি): মোট প্রকল্প ব্যয় ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা হলেও নতুন অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে ধরা হয়েছে ১৫৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আগের বরাদ্দ ছিল ৩১৫ কোটি টাকা। এখানে বরাদ্দ কমছে ১৫৭ কোটি টাকা।
৭. বঙ্গবন্ধু রেলসেতু প্রকল্প: আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৫৫৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা আগের ২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার তুলনায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা কম।
৮. ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: বরাদ্দ কমছে ৪৫৪ কোটি টাকা। আগের ৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার বরাদ্দ কমিয়ে করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।
৯. পদ্মা সেতু রেল সংযোগ: এই প্রকল্পেও বড় ধরনের কাটা হয়েছে। আগের বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা, যা কমিয়ে করা হয়েছে ১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা—এক বছরে কমছে ২ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা।
১০. দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথ: এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় পরিবর্তন হলো রামু-গুনদুম অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে, ফলে বরাদ্দও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে ৮৮৮ কোটি টাকা। নতুন বরাদ্দ ধরা হয়েছে মাত্র ৫৬২ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব প্রকল্পে নানামুখী জটিলতা, সময়ক্ষেপণ এবং ডিজাইন পরিবর্তনের কারণে অর্থের ব্যবহার নিয়ে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। বরাদ্দ কমানো হলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে না বরং এটি অপচয় রোধে সহায়ক হবে বলেও মত দেন তারা। বিশেষ করে রূপপুর প্রকল্পে যেহেতু বাড়তি নিরাপত্তা ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামো এখন আলাদা প্রকল্পে রূপ নিচ্ছে, মূল প্রকল্পে ব্যয় কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব মেগা প্রকল্প দেশের জন্য অপরিহার্য হলেও বাস্তবায়নে সময় ও খরচ নিয়ন্ত্রণে না আনলে ভবিষ্যতে জনস্বার্থের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তারা মনে করেন, বরাদ্দ হ্রাসের এই সিদ্ধান্তকে যদি পরিকল্পিত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নেওয়া হয়, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
বরাদ্দ কমলেও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গতি হারাবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও, বাস্তবিকভাবে এসব মেগা প্রকল্প কতটা সময়মতো ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারণ প্রকল্পের পেছনে জনগণের বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে, যার সুফল পেতে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ