
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার অপরাধজগতে যারা একসময় ত্রাসের নাম ছিলেন, সেই সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের জীবনকাহিনি এখন যেন এক রুদ্ধশ্বাস সিনেমার চেয়েও চমকপ্রদ। গুরু ও শিষ্যের এই জুটির উত্থান, সংঘাত, পলায়ন এবং পুনরায় ধরা পড়ার ঘটনাবলী বাস্তবকে ছাপিয়ে এক কাল্পনিক অপরাধ উপন্যাসের মতোই লাগছে। সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক এক অভিযানে তাদের একসঙ্গে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আবার আলোচনায় উঠে এসেছে এই ভয়ংকর জুটি।
সুব্রত বাইন: মগবাজারের গ্যাংস্টার থেকে আন্তর্জাতিক পলাতক
১৯৬৭ সালে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার জোবারপাড় গ্রামে জন্ম নেওয়া সুব্রত বাইন ঢাকায় বেড়ে উঠলেও তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় মগবাজারে এসে। অক্সফোর্ড মিশন স্কুল ও পরে শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করলেও অপরাধজগতে পা রাখেন এক ‘নেতা’র সংস্পর্শে এসে। মগবাজারে ‘সেভেন স্টার’ নামে একটি ভয়ংকর গ্যাং গড়ে তোলেন তিনি।
১৯৯০-এর দশকে সুব্রতের গ্যাং রাজধানী ঢাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। চাঁদাবাজি, খুন, অস্ত্র ব্যবসা—সবখানেই ছিল তাদের দাপট। এক পর্যায়ে মগবাজার, কাওরান বাজার থেকে রমনা পর্যন্ত ছিল সুব্রতের ‘এলাকা’। পুলিশের তালিকাভুক্ত খুনের মামলার সংখ্যা ৩০ ছাড়িয়ে যায়। চাঞ্চল্যকর মুরাদ হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন দণ্ড হয়।
তিনি শুধুমাত্র একজন অপরাধী নন, ছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কিছু প্রভাবশালী নেতার আশীর্বাদপুষ্টও। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর যে তালিকা প্রকাশ করে, সেখানে এক নম্বরে ছিল সুব্রতের নাম।
সেই সময় দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যান তিনি। সেখানে এক নারীকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করলেও অপরাধী পরিচিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। কলকাতার পুলিশ একাধিকবার তাকে গ্রেফতার করে। নেপালেও পালিয়ে যান এবং সেখান থেকে ২০১২ সালে নাটকীয়ভাবে সুড়ঙ্গ কেটে কারাগার থেকে পালান। পরে কলকাতা থেকে আবার ধরা পড়েন।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, গোপনে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে তাকে একটি ‘গোপন বন্দিশালায়’ রাখা হয়েছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আত্মগোপনে চলে যান, তবে শেষমেশ সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।
মোল্লা মাসুদ: ‘কিলিং মেশিন’ এর উত্থান ও পতন
মোল্লা মাসুদ ছিলেন সুব্রত বাইনের ডান হাত, ভয়ংকরতম খুনে সন্ত্রাসী। জন্ম ঝালকাঠির মহাদেবপুরে। ঢাকা শহরে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। একসময় ছাত্রলীগ, তারপর ছাত্রদল, এবং শেষে ইসলামী ছাত্রশিবিরেও ছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক ব্যর্থতা থেকে জন্ম নেয় আগ্রাসী হিংস্রতা। সেভেন স্টার গ্যাংয়ে যোগ দিয়ে দ্রুতই হয়ে ওঠেন ‘স্ট্রাইকার’। তাঁর নৃশংসতা ছিল অতুলনীয়। অন্তত ২৪টি খুনে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে রফিক, মুরগি মিলন, ও লিয়াকতের ওপর হামলার মতো বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ।
২০০৪ সালে তিনি ও সুব্রত দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যান। সেখানে নতুন নাম ‘রাসেল মাসুদ’ নিয়ে ভারতীয় নাগরিক রিজিয়া সুলতানাকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করলেও অপরাধচক্র থেকে বের হতে পারেননি। হুন্ডির মাধ্যমে ঢাকার বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় এবং জাল নোটের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
২০১৫ সালে ব্যারাকপুরে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার হন মাসুদ। সেই সময় থেকে তিনি কলকাতার জেলে বন্দি ছিলেন। সেখান থেকেই সাম্প্রতিক সময়ে ফেরত আনা হয় বাংলাদেশে।
দুই অপরাধীর জুটি: অপরাধজগতের ‘মাস্টার অ্যান্ড অ্যাসাসিন’
সুব্রত বাইন ছিলেন মগবাজার সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড, আর মোল্লা মাসুদ ছিলেন তার হত্যাকারী মেশিন। এদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের, কিন্তু বাস্তব অর্থে তারা ছিলেন অপরাধের দুই চূড়া—পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রতীক।
এক সময় ঢাকার অন্ধকার রাজনীতিতে তাদের ছায়া ছাড়া কোনো গ্যাংস্টার হিসাব গৃহীত হতো না। ‘সেভেন স্টার’ নামটি রীতিমতো আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এই দুইজনের উত্থান, বিচ্ছেদ, পালিয়ে থাকা এবং ফের ফিরে আসার গল্প ঢাকার অপরাধ ইতিহাসে এক ভয়ংকর দৃষ্টান্ত।
সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের জীবন যেন বাস্তবের ‘গডফাদার’-এর এক বাংলাদেশি সংস্করণ। এক সময়ের ত্রাস আজ রাষ্ট্রীয় জালে বন্দি। তাদের বিচার, শাস্তি এবং অপরাধজগত থেকে রাজনীতির দানবীয় সখ্য নিয়ে সমাজে আবারও প্রশ্ন জেগেছে—কতদিন চলবে এই অপরাধ-রাজনীতি জোট?
এখন দেখার বিষয়, তাদের গ্রেফতারের পর আন্ডারওয়ার্ল্ডে তৈরি হওয়া শূন্যতা কীভাবে পূরণ হয়, আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা সফল হয় ঢাকার অপরাধ সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান ঠেকাতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ