
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ফের উত্তেজনা বাড়ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি নয়াপল্টনে এক সমাবেশে আলটিমেটামের সুরে জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে। এমন বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিএনপি নতুন কৌশলে মাঠে নামছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—কেন ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায় বিএনপি? এবং এই চাপ তারা কতটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারবে?
কেন ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায় বিএনপি?
১. ‘ভোট হলেই জয়’– এই ধারণার ভিত্তি:
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি মনে করছে, তারা এখন ক্ষমতায় যাওয়ার সবচেয়ে অনুকূল সময় পার করছে। দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে— একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই বিএনপি বিজয়ী হবে। এ অবস্থায় সময় যত গড়াবে, পরিস্থিতি তত জটিল হয়ে উঠবে।
২. দলের ভেতরে অপরাধ ও শৃঙ্খলাভঙ্গ বেড়ে যাওয়া:
নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যে চাঁদাবাজি, দখল ও প্রভাব বিস্তারের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বলে বিএনপির অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে ধরা পড়েছে। নির্বাচন দেরি হলে দলের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে— এমন আশঙ্কা থেকেই দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ।
৩. ষড়যন্ত্রে কোণঠাসা হওয়ার ভয়:
বিএনপি মনে করছে, এনসিপি ও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপিকে একঘরে করার চেষ্টা করছে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের প্রতি এনসিপির ‘কাছাকাছি অবস্থান’ এবং জামায়াতের সুবিধাবাদী ভূমিকা বিএনপিকে চিন্তিত করেছে।
৪. সরকারের দুর্বলতা কাজে লাগানো:
বিএনপি মনে করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনীতি, ও প্রশাসন—সব দিকেই সরকার ব্যর্থ। এই অবস্থায় সরকারকে ব্যর্থ ও অজনপ্রিয় দেখিয়ে নির্বাচন দ্রুত করতে বাধ্য করার কৌশল নিচ্ছে বিএনপি।
বিএনপির দাবিতে কী সাড়া মিলছে?
সরকারের তরফে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে প্রধান উপদেষ্টা জাপান সফরেও ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের পুরনো অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ ভাবনা ঘিরে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা মোকাবেলায় গত সপ্তাহে তিনি ২২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।
বিএনপি কি একা হয়ে পড়ছে?
হ্যাঁ, নির্বাচনকাল নিয়ে বিএনপি ক্রমেই রাজনীতিতে একঘরে হয়ে পড়ছে:
জামায়াতে ইসলামী: জানুয়ারি-রোজার আগ/পরে নির্বাচন চায়।
এনসিপি: সরকারের সংস্কার পরিকল্পনার পর নির্বাচন চায়।
ইসলামপন্থি দলগুলো: সরকারপন্থী অবস্থানে রয়েছে।
বামপন্থি ছোট কিছু দল: ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়, তবে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব খুবই সীমিত।
এ অবস্থায় বিএনপি ছাড়া অন্য কেউ ডিসেম্বরের নির্বাচন চায় না। এতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্রসংখ্যা কমে যাচ্ছে।
বিএনপির কৌশল: কতটা সফল হবে?
১. জনগণ ও কর্মীদের মাঠে রাখার চেষ্টা:
তারেক রহমানের নির্দেশে ‘ডিসেম্বর প্রস্তুতি’ এখন দলের নতুন বার্তা। সমাবেশ, গণজমায়েতের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলতে চায় বিএনপি। তবে এসব কর্মসূচিতে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বাধা দিতে পারে, যা নতুন উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে।
২. সেনাবাহিনীর প্রতি প্রত্যাশা:
বিএনপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের ‘দ্বিতীয় প্রধান শক্তি’ সেনাবাহিনী তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। সরকার ও সেনাবাহিনীর সম্পর্ক শীতল—এই ধারণা বিএনপির কৌশলে বড় প্রভাব রাখছে।
৩. সহযোগিতা না করার হুমকি:
বিএনপি এখন স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে— নির্বাচনের রোডম্যাপ না এলে তারা সরকারের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা করবে না। এমন অবস্থান যদি বাস্তবে কার্যকর হয়, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংকট বাড়তে পারে।
সরকারের অবস্থান কী বলছে?
প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন—এই সরকার আগামী বছরের ৩০ জুনের পর আর ক্ষমতায় থাকবে না। অর্থাৎ ডিসেম্বরেই নির্বাচন হবে—এমন চাপ সরকার নিচ্ছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার কিছু সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচন আয়োজনের সময় নিচ্ছে। এসব সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দিলে সরকারের ‘মুখ রক্ষা’ কঠিন হবে।
কতটা সফল হবে বিএনপি?
বিএনপির ডিসেম্বর নির্বাচন দাবিতে এখন পর্যন্ত বড় সমর্থন নেই। সহযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত জামায়াত বা এনসিপিও একই কণ্ঠে কথা বলছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরিতে বিএনপির মূল শক্তি—জনগণের গণজমায়েত এবং রাজপথের কর্মসূচি।
কিন্তু রাজনৈতিক একঘরে অবস্থা ও নিজের দলের ভেতরের বিশৃঙ্খলা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বিএনপি এখনই সফলতার কাছাকাছি নয়। বরং ডিসেম্বরের দাবিতে অনড় থাকলে তারা আরও একা হয়ে পড়তে পারে।
অবশ্য রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যেতে পারে। সরকার যদি আর কোনো ভুল পদক্ষেপ নেয় বা সেনাবাহিনীর সমর্থন হারায়, তাহলে বিএনপির কৌশল কার্যকর হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ