
ছবি: সংগৃহীত
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতার চাপ সামলাতে আগামী অর্থবছর ২০২৫–২৬ এর বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ সরকার। মার্কিন পারস্পরিক শুল্কের চাপ সামলাতে দেশের আমদানিতে ১৩৫টি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে আনা হবে। এ ছাড়াও ৩০০ এর বেশি পণ্যের সম্পূরক শুল্কও হ্রাস করা হবে। এ ধরনের শুল্ক পরিবর্তন দেশের বাণিজ্যিক ও শিল্পখাতকে স্বস্তি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আইএমএফের সুপারিশ অনুযায়ী ৩১টি শিল্প খাতের কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহার করে তাদের করের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে একটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট, কৃষিযন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক্স উপাদান, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, মোবাইল ফোন, টেক্সটাইল মেশিনারি, রোবোটিক্স ডিজাইন এবং ন্যানোটেকনোলজি ভিত্তিক পণ্য উৎপাদন ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কর অবকাশ প্রত্যাহার দেশের কর ভিত্তি বাড়াবে এবং শিল্পখাতকে শক্তিশালী করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশের উন্নয়ন এবং এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়াকে সফল করতে শুল্ক কাঠামোকে আরো উন্নত করা হচ্ছে। নতুন শুল্ক কাঠামোতে ৭টি স্তর (০%, ১%, ৩%, ৫%, ১০%, ১৫%, ২৫%) নির্ধারণের প্রস্তাব রয়েছে। বিশেষ করে দেশের মধ্যে উৎপাদিত হয় না এমন গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের শুল্ক হার ৩ শতাংশ রাখা হবে। খাদ্যদ্রব্য, সার, বীজ, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, তুলাসহ শিল্পের কাঁচামালের শুল্ক অপরিবর্তিত থাকবে।
এদিকে আমদানিতে ‘এইচএস কোড’ ভুল বোঝাবুঝি ও ভুল ঘোষণার কারণে ব্যবসায়ীদের ওপর অপরিমেয় জরিমানা আরোপ হওয়ার ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী বাজেটে মিথ্যা ঘোষণার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪০০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ জরিমানা পর্যন্ত হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।
জুলাইযোদ্ধাদের আয়করে বিশেষ ছাড়
অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ২০২১ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত এবং সরকারি গেজেটভুক্ত ‘জুলাইযোদ্ধা’দের আয়করে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। সরকার আগামী দুই অর্থবছরের আয়ের জন্য (২০২৬–২৭ ও ২০২৭–২৮) এই ছাড় প্রয়োগ করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়ের সীমা বর্তমানে ৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্ত জুলাই আন্দোলনের ইতিহাস ও শহীদদের সম্মান জানাতে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। ইতিহাসের ঐ ঘটনায় আহত যারা, তাদের উন্নত চিকিৎসা এবং জীবনমান বৃদ্ধির জন্য আর্থিকভাবে সহায়তা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
নতুন বাজেটে সাধারণ ব্যক্তির করমুক্ত আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রয়েছে। তবে উচ্চবিত্তদের জন্য করের স্লাব আরও কঠোর হচ্ছে। যাদের বার্ষিক আয় ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি, তাদের ৩০% হারে কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে এই সীমা কমিয়ে ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হবে, ফলে উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের কর burden বাড়বে।
কর বিশেষজ্ঞ ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, “এ ধরনের কর কাঠামো সংস্কার বাংলাদেশের কর সংগ্রহ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে। উচ্চবিত্তদের কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগবে।”
অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী বাজেটে আইটি খাতের আয়কে করের আওতায় আনার প্রস্তাব করেছে। এর ফলে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ডেটা অ্যানালিটিক্স, সাইবার সিকিউরিটি, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট ও আইটি ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয় থেকে কর দিতে হবে। এর আগে এসব আয় ব্যক্তিগত করদাতাদের আয়ের বাইরে ছিল।
আইটি বিশেষজ্ঞ সায়মা করিম মন্তব্য করেন, “আইটি খাতের কর ব্যবস্থা সঠিক হলে সরকারের রাজস্ব উৎস বৃদ্ধি পাবে। তবে আইটি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ও স্পষ্ট নিয়ম থাকা জরুরি যাতে তারা কর প্রদান সহজে ও যথাযথভাবে করতে পারে।”
সার্বিকভাবে, আগামী বাজেটে শুল্ক হ্রাস, কর অবকাশ প্রত্যাহার এবং নতুন কর কাঠামোর মাধ্যমে সরকারের লক্ষ্য রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও জুলাইযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে কর সুবিধা প্রদান অর্থনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রতিফলন।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মো: নূরুল আমিন বলেন, “এই বাজেট পরিকল্পনা দেশের অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দাঁড় করানোর জন্য বড় ধাপে অগ্রসর হবে। তবে এর সঠিক বাস্তবায়ন ও নজরদারি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
এই সব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো গতিশীল হয়ে উঠবে এবং নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত উভয়ের করের গুণগত পরিবর্তন রাজস্ব বৃদ্ধি করবে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ