
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্ক্রিয় থাকার পর আবারও রাজধানীর রাজপথে দৃশ্যমান হতে যাচ্ছে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সদ্য সংঘটিত ছাত্র-জনতার সম্মিলিত গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পটভূমিতে এবার ঢাকায় প্রথমবারের মতো বড় পরিসরের একটি রাজনৈতিক জনসমাবেশের আয়োজন করতে যাচ্ছে দলটি। আগামী ২১ জুন, শুক্রবার, দুপুর ২টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা করছে জামায়াত। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-এর কাছে জনসভা আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতির আবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে।
শনিবার (৩১ মে) জামায়াতের কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান এবং দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের এ তথ্য গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা আগামী ২১ জুন দুপুর ২টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি শান্তিপূর্ণ জনসভা করতে চাই। সে অনুযায়ী ডিএমপির অনুমতির জন্য আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এই সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন। পাশাপাশি সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হবে।”
জুবায়ের জানান, এখনো স্থান নির্ধারণ চূড়ান্ত হয়নি। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, “সমাবেশ আয়োজনের স্থান বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষেই পরবর্তী প্রস্তুতি ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণাগুলো দেওয়া হবে। আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছি। দেশের জনগণকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে এই সমাবেশ গুরুত্বপূর্ণ এক মোড় হবে।”
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, এই জনসভাকে ঘিরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ঢাকায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরই মধ্যে দলীয়ভাবে সাংগঠনিক প্রচার, জনমত গঠনের কাজ এবং কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা এই সমাবেশকে ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি ও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছানোর একটি ঐতিহাসিক সুযোগ’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের রাজনীতিতে বিরাজ করছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও নতুন সম্ভাবনার যুগ। রাজনৈতিক দলগুলো নতুন করে সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপি ও বিভিন্ন বাম-ডানপন্থী দল রাজধানীতে একাধিক জনসমাবেশ করেছে। তবে, দীর্ঘ সময় ধরে নিষিদ্ধ রাজনীতির ধারা পেরিয়ে জামায়াত এই প্রথম ঢাকায় একটি বড় সমাবেশ করতে যাচ্ছে, যা তাদের রাজনৈতিকভাবে পুনরায় দৃশ্যপটে আবির্ভূতেরই ইঙ্গিত দেয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সমাবেশের মাধ্যমে জামায়াত নিজেকে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় অভিযোজিত করার পাশাপাশি অতীতের বিতর্কিত অধ্যায় থেকে বের হয়ে একটি গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালাবে।
এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে দলটি কেবল রাজধানীতে তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতি জানাতেই চায় না, বরং এটি হতে পারে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের সূচনা। দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, আগামী সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক পরিবেশ বিবেচনায় রেখে জামায়াত এখন থেকে মাঠে সক্রিয় থাকতে চায়। তারা দেশের জনগণের কাছে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করবে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জামায়াতের সামনে এখনো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একদিকে দলটির অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য জনমনে কিছু নেতিবাচক ধারণা রয়ে গেছে, অন্যদিকে ২০১৩ সালে দলীয় নিবন্ধন বাতিলের পর থেকে তাদের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যদিও জামায়াত এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নতুন করে নিবন্ধনের জন্য আইনি লড়াই শুরু করেছে, সেই প্রক্রিয়ার ফলাফল এখনও অনিশ্চিত।
এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের সমাবেশ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর কর্তৃপক্ষের কড়া নজর থাকবে। অতীতে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে যেসব বিতর্ক ছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সে বিষয়েও প্রশাসন সতর্ক থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আগামী ২১ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের এই ঘোষণা রাজধানী ঢাকায় এক নতুন রাজনৈতিক আবহের জন্ম দিতে পারে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ফাঁকা হয়ে পড়া রাজধানীর রাজপথ আবারো নানা রাজনৈতিক শক্তির মুখোমুখি অবস্থান এবং নতুন জোট ও মেরুকরণের দিকে এগোতে পারে। জামায়াতে ইসলামীর এই উদ্যোগ শুধু তাদের সংগঠন পুনর্গঠনের অংশ নয়, বরং এটি হতে পারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এখন দেখার বিষয়, সরকার প্রশাসনিক দিক থেকে এই সমাবেশের অনুমতি দেয় কিনা এবং সেই সমাবেশ কতটা সুশৃঙ্খল ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ