
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের উত্তপ্ত আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা হিসেবে আগামী ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত একটি ফ্রেমওয়ার্ক দিলেও রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশ এই দীর্ঘ সময়সীমা মেনে নিতে নারাজ। তারা বলছে, অতিরিক্ত সময় শুধু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়াবে, ফলে দ্রুত নির্বাচনই জাতীয় স্বার্থে সবচেয়ে জরুরি।
বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বে ৫৩টি রাজনৈতিক দল সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে, তারা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে চায়। এসব দলের ভাষ্য, এর চেয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দিলে সেটি সরকারের ও প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব প্রমাণ করবে। যদিও প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি জাপান সফরকালীন এক বক্তব্যে বলেন, "শুধু একটি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়", যা বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “বর্তমান সরকার নয় মাসে যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় তাদের হাতে দীর্ঘ সময় দেওয়া অর্থহীন। ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়াটাই বাস্তবসম্মত।” তিনি আরও বলেন, “আগে নির্বাচন দিলে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত হবে, বিক্ষুব্ধ জনমতও অংশগ্রহণে আগ্রহী হবে।”
একই সুরে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “ডিসেম্বর তো বটেই, চাইলে নভেম্বরেও নির্বাচন সম্ভব। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান ভোটের মাধ্যমেই হতে পারে।”
বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, “নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরে সময়টা যথার্থ। এর চেয়ে দেরি হলে জনগণের মধ্যে অনাস্থা বাড়বে।”
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)-এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, “ডিসেম্বর তো পরের কথা, যদি অক্টোবরেও নির্বাচন সম্ভব হয়, তবু আমাদের আপত্তি নেই।”
১২ দলীয় জোটের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা বিলম্বিত করার চেষ্টা চলছে। মূলত কিছু ধর্মভিত্তিক দলকে পাশে রেখে সরকারপ্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চান।” বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “দেশের সব গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়। বরং বিলম্ব ঘটলে তা হতে পারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
অপরদিকে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে সংস্কারের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট তারিখও জরুরি।”
এলডিপির মহাসচিব ডা. রেদোয়ান আহমেদ বলেন, “এই মুহূর্তে সময়ক্ষেপণের কোনো অবকাশ নেই। প্রশাসন চাইলে নির্বাচনী কাঠামো ডিসেম্বরেই প্রস্তুত করা সম্ভব।”
যদিও বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী দাবিতে একমত নয় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জামায়াতের মুখপাত্র এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, “আমরা চাই রোজার আগে ফেব্রুয়ারি অথবা পরে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন। এই সময়টি জনগণের জন্য সুবিধাজনক হবে।”
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুছ আহমাদ বলেন, “অবকাঠামোগত সংস্কার ও বিচারের প্রতিশ্রুতি দৃশ্যমান করতে হবে। না হলে তাড়াহুড়ো করে আবার আগের মতো নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া হবে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আরও এগিয়ে গিয়ে নির্বাচনের আগে একটি ‘রোডম্যাপ’ দাবি করেছে—যাতে থাকবে বিচার, সংস্কার ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নুরুল আলম বলেন, “ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হলে সেটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য মাইলফলক হবে। তদ্বিপরীত, দীর্ঘসূত্রতা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ হতে পারে।” তিনি বলেন, “বহু বছর পর এমন রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, যা প্রশাসনের জন্য একটি সুযোগ।”
আরেকজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সময় নয়, সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। এখন মূল প্রশ্ন হলো- প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই সদিচ্ছা দেখাতে প্রস্তুত কিনা।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হয়, তবে মাঠে থাকা রাজনৈতিক শক্তিগুলোর হতাশা ও ক্ষোভ দানা বাঁধবে। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের ঝুঁকি বাড়বে।
বিএনপি ইতিমধ্যেই অন্তত ৬০টি দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে। এদের মধ্যে ৫২টি দল একমত যে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন প্রয়োজন। এর মধ্যে ৩০টির বেশি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে।
সবমিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের নির্বাচনী উত্তাপ বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী না থাকলেও প্রধান উপদেষ্টার আশ্বাস, দলগুলোর দাবির সঙ্গে মেলেনি। এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফেরানো। নইলে প্রশাসন ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপর যে আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা আরও গভীর হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত নির্বাচন না দিলে অন্তর্বর্তী সরকারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। এখন দেখার বিষয়, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবির সামনে সরকার ও নির্বাচন কমিশন কী অবস্থান নেয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ