
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে পণ্যের ওপর শুল্ক ও ভ্যাটহার পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে উদ্যোগ নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ লক্ষ্যেই এবার বাজেটে শুল্ক ও কর বাড়ানো এবং কমানোর একটি বড় তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এতে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ব্যবহার্য অনেক পণ্যের দাম বাড়তে পারে, আবার কিছু পণ্যে দাম কমে কিছুটা স্বস্তিও আসতে পারে সাধারণ মানুষের জন্য।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতিবছর বাজেট প্রণয়নের সময় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম প্রধান কৌশল হিসেবে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও আমদানি শুল্ক কাঠামোতে পরিবর্তন আনে। এবারো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তবে এবারের বাজেটে শুল্ক-কর বাড়ানোর তালিকা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক দীর্ঘ হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এতে বাজারে অধিকাংশ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ব্যয়ের ওপর।
যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে
ইলেকট্রনিক্স পণ্য: ফ্রিজ ও এসি
দেশীয় শিল্পে অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে সরে আসার অংশ হিসেবে এবার রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনারের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ফলে দেশীয়ভাবে উৎপাদিত ফ্রিজ ও এসির দাম বাড়বে। একইসঙ্গে বিদেশি ইলেকট্রনিক্স পণ্যের আমদানিও বাড়তে পারে।
মোবাইল ফোন
দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজন পর্যায়ে হ্রাসকৃত ভ্যাটহার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্যাটাগরিভেদে ২ থেকে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট বাড়ানো হবে, যা দেশীয় মোবাইলের দাম বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
সেলুনে ব্যবহৃত ব্লেড
স্টেইনলেস স্টিল ও কার্বন স্টিলের স্ট্রিপ থেকে তৈরি ব্লেডের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে সেলুন ও ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবহৃত ব্লেডের দাম বাড়তে পারে।
বাস-ট্রাক বডি নির্মাণ
বাস ও ট্রাকের বডি তৈরি কার্যক্রমে এবার প্রথমবারের মতো ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। ফলে যানবাহনগুলোর চূড়ান্ত দাম বাড়বে।
প্লাস্টিক টেবিলওয়্যার ও গৃহস্থালি পণ্য
প্লাস্টিকের তৈরি টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, টয়লেট সামগ্রী এবং হাইজেনিক পণ্যের উৎপাদনে ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে এসব দৈনন্দিন ব্যবহৃত পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে।
টেক্সটাইলের সুতা
দেশীয় মিলে উৎপাদিত কটন ও সিনথেটিক সুতার ওপর সুনির্দিষ্ট কর বাড়ানো হচ্ছে—প্রতি কেজিতে ৩ টাকা থেকে ৫ টাকা। ফলে দেশীয় গামছা, লুঙ্গি ও অন্যান্য কাপড়ের দাম বাড়তে পারে।
নির্মাণ উপকরণ: রড ও বিলেট
রড ও এঙ্গেল বারের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত স্ক্র্যাপে সুনির্দিষ্ট কর ১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২০০ টাকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিলেট-ইনগটের কর এবং ফার্নেসে ব্যবহৃত রাসায়নিক ফেরো ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো সিলিকা ম্যাঙ্গানিজেও শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে, যার ফলে নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাবে।
হেলিকপ্টার আমদানি
নতুন অর্থবছরে হেলিকপ্টার আমদানিতে ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রয়েছে। এতে ব্যক্তিমালিকানাধীন হেলিকপ্টার বা বাণিজ্যিক হেলিকপ্টার আমদানির খরচ বেড়ে যাবে।
কসমেটিক্স
নারীদের ব্যবহার্য কসমেটিক্স পণ্য—যেমন লিপস্টিক, লিপলাইনার, আইলাইনার, মেকআপ কিট ইত্যাদির আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি কেজি লিপস্টিকের ক্ষেত্রে ২০ ডলারের পরিবর্তে ৪০ ডলার নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে বিদেশি কসমেটিক্সের দাম অনেকটা বাড়বে।
চকোলেট ও খেলনা
বিদেশি চকোলেট আমদানির ন্যূনতম মূল্য ৪ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১০ ডলার করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। একইভাবে বিদেশি খেলনার ট্যারিফ মূল্যও বাড়ানো হচ্ছে। এতে শিশুদের প্রিয় এসব পণ্যের দাম বাড়বে।
মার্বেল ও গ্রানাইট
বাসা-বাড়ির মেঝে নির্মাণে ব্যবহৃত মার্বেল ও গ্রানাইট পাথরের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বাড়ি নির্মাণে খরচ বাড়বে।
ব্যাটারি রিকশার মোটর
৭৫০ ওয়াট ডিসি মোটরের ওপর শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে ব্যাটারিচালিত রিকশার দাম বাড়বে, যা গণপরিবহন খাতে প্রভাব ফেলবে।
অন্যান্য পণ্য
শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাবে আরও যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে:
মাখন (বিশেষত দেশি মাখন)
তারকাঁটা, স্ক্রু, নাট-বোল্ট
ইলেকট্রিক লাইন হার্ডওয়্যার, পোল ফিটিংস
সেল্ফ কপি পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড
ওয়ানটাইম প্লাস্টিক গ্লাস, প্লেট, বাটি
তামাক বীজ, মোটরসাইকেল ও সাইকেলের যন্ত্রাংশ
মাতৃসুস্থতা সংক্রান্ত ফুড সাপ্লিমেন্ট
বেভারেজ ও দরজার তালা
যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে
আইসক্রিম
বিভিন্ন বয়সী মানুষের পছন্দের আইসক্রিমে সরবরাহ পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বাজারে আইসক্রিম কিছুটা সস্তা হতে পারে।
বাস ও মাইক্রোবাস
১৬ থেকে ৪০ আসনের বাস আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। মাইক্রোবাসের পূর্ণ শুল্কহার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে গণপরিবহন খাতে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে।
লবণ
পটাশিয়াম আয়োডেটের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হচ্ছে, যা আয়োডিনযুক্ত লবণের মূল উপাদান। ফলে বাজারে লবণের দাম কিছুটা কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
চিনি
পরিশোধিত চিনির আমদানিতে সুনির্দিষ্ট শুল্ক টনপ্রতি ৪৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৪০০০ টাকা করা হচ্ছে, যাতে চিনির বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
শিরিশ কাগজ
শিরিশ কাগজ তৈরির কাঁচামাল ফেনোলিক রেজিন ও স্যান্ড পেপার কোটিং ম্যাটেরিয়ালের আমদানি শুল্ক কমানো হচ্ছে। ফলে দেশি শিরিশ কাগজের উৎপাদন খরচ কমবে এবং বাজারে দাম কমবে।
ক্রিকেট ব্যাট
দেশীয় ব্যাট শিল্পকে উৎসাহ দিতে ব্যাট তৈরির প্রধান কাঁচামাল কাঠ আমদানির শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৬ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে দেশি ব্যাটের দাম কমে জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে পারে।
অন্যান্য পণ্য
পোড়ামাটির তৈরি পরিবেশবান্ধব প্লেট, গ্লাস ও বাটি
জাপানি সী-ফুড স্ক্যালোপ (শুল্ক ২৫% থেকে ৫%)
হোস পাইপ
বিদেশি মাখন ও কিছু ড্রিংকস
বাজেটের শুল্ক ও ভ্যাট কাঠামোর পরিবর্তনের কারণে এবার পণ্যের দামের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যপূরণে নানা ধরনের ভর্তুকি ও কর ছাড় কমিয়ে আনার ফলে একদিকে ভোক্তাদের ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে মিলতে পারে সামান্য স্বস্তি। বাজেট ঘোষণার পরই এর পূর্ণ প্রভাব বাজারে দেখা যাবে। এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই পণ্যের মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ফলে সাধারণ মানুষকে এবারের বাজেটের পর খরচের হিসাব নতুন করে গুছিয়ে নিতে হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ