
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরকার ও বিএনপির মধ্যকার দূরত্ব ক্রমেই তীব্র রাজনৈতিক তিক্ততায় রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। নির্বাচনের সময়সীমা, রোডম্যাপ ও অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি দু'পক্ষের কণ্ঠে যে ধরণের কঠোরতা শোনা যাচ্ছে, তাতে করে রাজনৈতিক পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই।
বিশেষ করে গত এক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ, রাজনৈতিক বক্তৃতা, এবং সরকারি পর্যায় থেকে প্রতিক্রিয়ার ধরন বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—এখন আর শুধু সমন্বয়ের অভাব নয়, বরং অবিশ্বাস এবং উত্তেজনাও দিন দিন বাড়ছে।
সরকারের কাছে একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ ও ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোটের তারিখ ঘোষণার দাবি বারবার উচ্চারণ করে আসছে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় সব নেতাই সম্প্রতি কঠোর ভাষায় তাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন।
গত ২৮ মে ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশে ভার্চুয়ালি দেওয়া এক বক্তৃতায় তারেক রহমান বলেন, “জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো টালবাহানা চলবে না। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে।” এই বক্তব্যের কিছুক্ষণের মধ্যেই জাপান সফরে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন বিষয়ে পূর্বের অবস্থান পুনরায় তুলে ধরেন, যেখানে বলা হয় যে “ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে যেকোনো সময় নির্বাচন হতে পারে।”
তার এই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি এবং তাদের সমমনা ৩৪টি রাজনৈতিক দল। নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এলডিপি ও বিজেপিসহ এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, “ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে—এটা শুধু বিএনপির দাবি নয়, বরং গণমানুষের দাবিও।”
এরপর গত শুক্রবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে দেশে আর কোনোদিন নির্বাচন হবে না।” এ বক্তব্য আরও পরিষ্কার করে দেয় যে বিএনপি এখন আর কোনরকম বিলম্ব মেনে নিতে রাজি নয়।
জাপানের “ফিউচার অব এশিয়া” সম্মেলনে অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যখন বলেন, “সব দল নয়, একটি নির্দিষ্ট দল ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়,” তখন সেটিকে বিএনপি সরাসরি ‘পক্ষপাতদুষ্ট মন্তব্য’ হিসেবে অভিহিত করে। দলটির নেতারা মনে করছেন, এমন বক্তব্য বাস্তব সংকটকে অস্বীকার করে উল্টো বিএনপিকে ঘায়েল করার কৌশল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. সাইফুল আলম চৌধুরী বলছেন, “প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টতই টাগ অব ওয়ারে যেতে চাইছেন। তিনি বিএনপিকে চাপে রাখতে চাইছেন এবং এটিই বর্তমান সরকার ব্যবস্থার নতুন রাজনৈতিক কৌশল।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার এখনো সংস্কার ও বিচারকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, কিন্তু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রস্তুতি এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা হচ্ছে না। এই অবস্থায় বিএনপি শক্ত অবস্থান না নিলে তারা আবারও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত হতে পারে—সেই শঙ্কা থেকেই তারা রূঢ় হচ্ছে।”
দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ছিল অপেক্ষাকৃত নীরব ও সরকারের প্রতি সহনশীল। কিন্তু দলটির শীর্ষ নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম মুক্তি পাওয়ার পর এবং নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার পথ সুগম হওয়ার পর, তাদের কণ্ঠেও এখন নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়ে উঠছে।
জামায়াত নেতারা স্পষ্টভাবে বলছেন—“ফেব্রুয়ারি মাসের রোজার আগে বা পরে নির্বাচন হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যাবে, কিন্তু তার পরে নয়।”
এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষক সাইফুল আলম বলেন, “জামায়াত সরকারের কাছ থেকে তাদের চাওয়া পূরণের পর এখন পুরোদমে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির সঙ্গী হয়ে উঠবে। ফলে তিক্ততা শুধু বিএনপির সঙ্গে নয়, বরং বড় পরিসরে আরও অনেক দলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কই সংকটে পড়বে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, “নির্বাচনের দাবি দিন দিন যেভাবে তীব্র হচ্ছে, তা কেবল দলীয় আবেগ নয়—এটি এখন একটি জাতীয় রাজনৈতিক চাপ। সরকার যদি শিগগিরই তারিখ ঘোষণা না করে, তবে স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নেবে।”
তিনি আরও বলেন, “সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং বিচার দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এগুলোর অজুহাতে নির্বাচন বিলম্ব করা হলে তা গণতন্ত্রের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিশেষ করে যখন শিক্ষাবর্ষ, রোজা, এইচএসসি পরীক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এমনকি জুনে বিশ্বকাপ ফুটবল—সব মিলে নির্বাচন আয়োজন আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।”
অধ্যাপক রহমান বলেন, “এই পরিস্থিতিতে এখন যদি সরকার রোডম্যাপ ঘোষণা না করে, তাহলে বিএনপির কাছ থেকে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। তারা মাঠে নামবে, তা নিশ্চিত। তখন সরকারও কঠোর হবে। সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠবে।”
তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত রোডম্যাপ না আসলেও, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, “আগামী ৩০ জুনের আগেই যেকোনো সময়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। সরকার সে প্রস্তুতি নিয়েই এগোচ্ছে।”
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই এই বক্তব্যকে ‘কৌশলী ভাষা’ বলেই মনে করছেন। তাদের মতে, সরকার এখনো সময় কিনতে চাইছে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে সরকার কতটা আন্তরিক ও প্রস্তুত। নির্বাচন কমিশন এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো তারিখ ঘোষণা করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা যেসব বৈঠক করছেন তা কতটা কার্যকর হবে, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ।
একজন প্রবীণ বিশ্লেষক বলেন, “এখন পর্যন্ত বিএনপি অপেক্ষাকৃত সহনশীল থাকলেও, সময় ফুরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কণ্ঠ আরও কঠোর হবে। সরকার যদি রোডম্যাপ না দেয়, তাহলে বিরোধী দলগুলো আবারও আন্দোলন বা গণবিক্ষোভের পথে যাবে—এটি অপ্রতিরোধ্য হবে।”
অর্থাৎ এক কথায়, এখন নির্বাচনকে সামনে রেখে সময়ের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না জানালে রাজনৈতিক উত্তাপ শুধু বাড়বে এবং সরকার ও বিএনপির দূরত্ব শিগগিরই সংঘাতের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হলে এখনই রোডম্যাপ ঘোষণা ও দ্বিপাক্ষিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ