
ছবি: সংগৃহীত
বড় রানের ইনিংস, দুর্দান্ত শুরুর পরও শেষ রক্ষা হলো না বাংলাদেশের। সিরিজের শেষ ম্যাচে একমাত্র সান্ত্বনার জয়ের আশায় মাঠে নামা টাইগাররা তৃতীয় ম্যাচেও হারলো পাকিস্তানের কাছে। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে সফরকারীদের ছুঁড়ে দেওয়া ১৯৭ রানের চ্যালেঞ্জ অনায়াসেই পেরিয়ে যায় স্বাগতিকরা। মাত্র ১৬ বল হাতে রেখে ৭ উইকেটে জয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান পূর্ণ করে সিরিজ হোয়াইটওয়াশ।
এই হারের মধ্য দিয়ে শুধু একটি সিরিজ হারেই থেমে থাকেনি বাংলাদেশ। বরং প্রশ্নের মুখে পড়েছে দলের সামগ্রিক পারফরম্যান্স, বিশেষ করে বোলিং আক্রমণের কার্যকারিতা এবং ব্যাটিংয়ের ধারাবাহিকতা। অনেকটা আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না আসায় হতাশা যেন আরও বাড়িয়ে দিলো।
বাংলাদেশের ব্যাটিং শুরুটা ছিল ঝড়ের গতিতে। প্রথম উইকেটে তানজিদ হাসান তামিম ও পারভেজ হোসেন ইমন গড়েন দৃষ্টিনন্দন ১১০ রানের জুটি। সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে ব্যর্থতা ঘোচাতে মরিয়া দুই ওপেনারের ব্যাটে ভর করেই বাংলাদেশের ইনিংস পায় কাঙ্ক্ষিত গতি।
তানজিদ খেলেন ৩২ বলে ৪২ রানের ইনিংস, যেখানে ছিল ৫টি চার ও ১টি ছক্কা। অন্যদিকে পারভেজ হোসেন ইমন ছিলেন আরও আগ্রাসী। ৩৪ বলে করেন ৬৬ রান, মারেন ৭টি চার ও ৪টি বিশাল ছক্কা। ইমনের ব্যাটিং ছিল আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর, যেন বলছিলেন—এই ম্যাচে হোয়াইটওয়াশ হতে দেওয়া যাবে না।
ওপেনিং জুটির পর ক্রিজে আসেন লিটন দাস। ১৮ বলে ২২ রান করে তিনি কিছুটা গতি ধরে রাখার চেষ্টা করলেও ইনিংসের মাঝপথে উইকেট পতনের ধারা শুরু হয়। মিডল অর্ডারে তাওহিদ হৃদয় ১৮ বলে ২৫, শামীম হোসেন ৬ ও জাকের আলী ৯ বলে ১৫ রানে অপরাজিত থাকেন।
১৫তম ওভারেই বাংলাদেশের স্কোরবোর্ড ছুঁয়ে ফেলে ১৫০ রান। তৎপরবর্তী পাঁচ ওভারে রান আসে মাত্র ৪৬। যার কারণে, ২০০ রানের ম্যাজিক ফিগার ছোঁয়া হয়নি। শেষদিকে রানরেটের পতনে ইনিংস থামে ১৯৬ রানে।
তবুও এই ইনিংসে এক নতুন রেকর্ড যুক্ত হয় বাংলাদেশের নামের পাশে। পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। পূর্বে, ২০১২ সালে পাল্লেকেলেতে করা ১৭৫ ছিল সর্বোচ্চ।
বড় লক্ষ্য রক্ষায় ভালো শুরুর বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যেই প্রথম ওভারে আঘাত হানেন মেহেদী হাসান মিরাজ। মাত্র ১ রানে আউট করেন ওপেনার সাহিবজাদা ফারহানকে। মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
কিন্তু সেই আশায় দ্রুত জল ঢেলে দেন মোহাম্মদ হারিস ও সাইম আইয়ুব। দ্বিতীয় উইকেটে দুজন মিলে গড়েন ৯২ রানের দুর্দান্ত জুটি। সাইম আইয়ুব খেলেন ২৯ বলে ৪৫ রানের ইনিংস, যেখানে ছিল ৫টি চার ও ১টি ছক্কা।
তবে এই ম্যাচের নায়ক ছিলেন একমাত্র হারিস। ৪৬ বলে ঝড়ো ১০৭ রানের ইনিংস খেলে বাংলাদেশের সব আশাকে ছিন্নভিন্ন করে দেন তিনি। তার ইনিংসে ছিল ৮টি চার ও ৭টি ছক্কার মার। আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের এটিই তার প্রথম সেঞ্চুরি, এবং নিঃসন্দেহে এক স্মরণীয় ইনিংস।
হারিস আউট হওয়ার আগেই পাকিস্তানের জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। তার বিদায়ের পরও ব্যাটিংয়ে কোনো ভাটা পড়েনি। আজম খান ও ইফতিখার আহমেদ দায়িত্ব নিয়ে ম্যাচ শেষ করেন।
বাংলাদেশের বোলাররা ছিলেন কার্যত নিষ্প্রভ। মেহেদী হাসান মিরাজ ৪ ওভারে ২ উইকেট নিলেও ৩৭ রান দিয়েছেন। তানজিম হাসান সাকিব একমাত্র অন্য উইকেটটি পেলেও ৩ ওভারে খরচ করেন ৩৬ রান। রেজাউর রহমান রাজা, শরিফুল ইসলাম, সৌম্য সরকার—কারোরই বল হাতে কোনো কার্যকর প্রভাব পড়েনি।
যেখানে পাকিস্তানের ব্যাটাররা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী ও ছন্দে, সেখানে বাংলাদেশের বোলাররা ছিলেন খেই হারানো। ডেথ ওভারে পরিকল্পনার ঘাটতি, বৈচিত্র্যের অভাব আর ইয়র্কার না থাকায় ব্যাটারদের থামানোই সম্ভব হয়নি।
এই সিরিজে বাংলাদেশের ব্যাটিং ইউনিট কিছুটা আলো ছড়ালেও বোলিং আক্রমণ ছিল পুরোপুরি দিশেহারা। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বল হাতে কার্যকর কেউ ছিলেন না, বিশেষ করে পাকিস্তানের ইনফর্ম ব্যাটারদের সামনে।
যেখানে পাকিস্তান ধারাবাহিকতা ও আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমেছে, সেখানে বাংলাদেশ বারবার পরিকল্পনায় ঘাটতি এবং কার্যকর কৌশলহীনতার পরিচয় দিয়েছে।
হোয়াইটওয়াশ হয়ে দেশে ফিরছে বাংলাদেশ। কিন্তু শুধু হারের ভার নয়, ফিরছে অনেক প্রশ্ন, অনেক সমালোচনার ঝড় নিয়ে—বিশ্বকাপের আগে যা বড় এক সতর্কবার্তা হতে পারে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এই সিরিজটি ছিল প্রস্তুতির অন্যতম বড় মঞ্চ। কিন্তু ফলাফল বলছে—প্রস্তুতির চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে আত্মবিশ্বাসের সংকট। দলের ব্যাটিং অর্ডার থেকে শুরু করে বোলিং পরিকল্পনা—সবই এখন পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
পাকিস্তানের মাটিতে এমন একতরফা হোয়াইটওয়াশ দলের মেন্টালিটি, প্রস্তুতি ও গেমপ্ল্যানের দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। এখন দেখার বিষয়, কত দ্রুত এই দল ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং ঘনিয়ে আসা বৈশ্বিক মঞ্চে নিজেকে কতটা পুনর্গঠন করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ