
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৪ বছরে পা রাখার প্রাক্কালে আজ যখন জাতি নতুন বাজেটের অপেক্ষায়, তখন পিছনে ফিরে তাকানো জরুরি হয়ে পড়ে—এই দীর্ঘ সময়ে কেমন ছিল রাষ্ট্রের বাজেট-ভিত্তিক আর্থিক পরিকল্পনা, উন্নয়ন ব্যয়ের ধারা ও অর্থনৈতিক দিকচক্রবাল? আগামীকাল (৩ জুন ২০২৫) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন। এটি হবে বাংলাদেশের ৫৪তম এবং তার ব্যক্তিগতভাবে প্রথম বাজেট। তিনি বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বেও রয়েছেন। বাজেট ঘোষণার এই প্রাকমুহূর্তে পেছনের ৫৩টি বাজেটের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে শুধু পরিসংখ্যান নয়, ফুটে ওঠে রাজনৈতিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক প্রবণতা ও উন্নয়ন কৌশলের গতিপথ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে তাজউদ্দিন আহমেদ পেশ করেন দেশের প্রথম বাজেট। তখন জাতীয় বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ৫০১ কোটি টাকা। অতি সংকটাপন্ন অর্থনীতির মধ্যেও এই বাজেট ছিল ভবিষ্যতের রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক রূপরেখা।
পরের বছরগুলোয় তিনিই বাজেট পেশ করেন—১৯৭৩-৭৪ ও ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরেও। এ সময় বাজেটের পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও (৯৯৫ কোটি টাকা থেকে ১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা), এডিপি বরাদ্দ স্থির ছিল ৫২৫ কোটির ঘরেই।
১৯৭৫ সালের পর সামরিক শাসনের ছায়ায় বাজেট পেশ শুরু করেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক এবং পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজেই। ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে বাজেট দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা এবং এডিপি ৯৫০ কোটি। এরপর কয়েক বছর বাজেটের আকার দ্রুত বাড়তে থাকে:
১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে বাজেট হয় ২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা
১৯৭৯-৮০ তে ড. এম এন হুদার সময় বাজেট হয়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা
এরপর ১৯৮০-৮১ থেকে সাইফুর রহমানের উত্থান শুরু হয় বাজেট উপস্থাপনায়, যিনি দীর্ঘকাল ধরে বাজেট পেশে রেকর্ড গড়েন।
১৯৮০-এর দশকে বাজেট ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। ১৯৮৩-৮৪ তে মুহিত সাহেব পেশ করেন ৫ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকার বাজেট। তখন এডিপি বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪৮৩ কোটি। পরবর্তী সময় এম সাইয়েদুজ্জামান, ড. ওয়াহিদুল হক এবং মেজর জেনারেল মুনিমের মতো ব্যক্তিরাও বাজেট পেশ করেন। ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে বাজেট অতিক্রম করে ১২ হাজার কোটি টাকার সীমা।
এরপর ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বাজেটের ধারা নতুন আঙ্গিকে রূপ নেয়। সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট হয় ১৫ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা, যেখানে এডিপি বরাদ্দ ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর নাগাদ বাজেট দাঁড়ায় ২৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকায়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শাহ এ এম এস কিবরিয়া বাজেট পেশ করেন টানা পাঁচবার। তখন বাজেট ধাপে ধাপে বাড়ে—১৯৯৬-৯৭ এ ২৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা থেকে শুরু করে ২০০১-০২ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকায়। কিবরিয়া আমলে উন্নয়ন বাজেটেও ছিল প্রবল জোর।
এরপর আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে ২০০২-২০০৬ সময়কালে সাইফুর রহমান বাজেট পেশ করেন মোট ৫ বার। এই সময় বাজেটের আকার এক লাফে বড় হয়—২০০৬-০৭ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।
২০০৭ ও ২০০৮ সালে মির্জা আজিজুল ইসলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে বাজেট দেন সমপরিমাণে (৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা)। এরপর আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এ এম এ মুহিত বাজেট উপস্থাপনায় নেতৃত্ব দেন টানা দশ বছর। তার আমলে বাজেট আকার প্রথমবারের মতো ‘লক্ষ্মীছাড়া’ হয়ে দাঁড়ায়:
২০০৯-১০: ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা
২০১৩-১৪: ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা
২০১৮-১৯: ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা (এডিপি ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি)
মুহিত বাজেটের আকার বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে বেশ কিছু উদ্যোগ নেন।
২০১৯ সাল থেকে আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট পেশ শুরু করেন এবং চার বছরেই বাজেটের আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়:
২০১৯-২০: ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা
২০২১-২২: ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা
২০২৩-২৪: ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা
২০২৪-২৫: এ এইচ মাহমুদ আলীর সময় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট
এই সময় এডিপির আকারও ছিল রেকর্ড পরিমাণ—সবশেষ ২০২৪-২৫ সালে তা ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক বাজেট পেশ করেছেন দুইজন বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ—এ এম এ মুহিত ও এম সাইফুর রহমান। উভয়েই সমানভাবে ১২টি করে বাজেট পেশ করেছেন, যা জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবদান ও প্রভাবের একটি দৃষ্টান্তমূলক স্বীকৃতি।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট হবে এক নতুন যুগের সূচনা। অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক সংকোচন, রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা, ও বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে এই বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কেমন ধরনের নীতিকাঠামো নির্ধারণ করবেন, সেটিই এখন জাতীয় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাদেশের বাজেট ইতিহাস শুধু সংখ্যার খেলা নয়; এটি রাজনৈতিক বাস্তবতা, অর্থনৈতিক চিন্তাধারা, এবং জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। ৫৩টি বাজেটের ধারায় পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট—যেখানে প্রথম বাজেটের তুলনায় সাম্প্রতিক বাজেট প্রায় ১,০১৫ গুণ বড়। নতুন বাজেট শুধু আগামী অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাবই নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি কৌশলগত নির্দেশনাও বটে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ