
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক যুগের নিষেধাজ্ঞা শেষে আবারও বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া বহুল আলোচিত রায় বাতিল করেছে। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) দলটির নিবন্ধন পুনঃস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তবে, জামায়াতের অতীতে ব্যবহৃত দলীয় প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেননি আদালত। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
রোববার (১ জুন) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক রায় দেন। বেঞ্চের অন্যান্য বিচারপতিরা ছিলেন মো. আশফাকুল ইসলাম, জোবায়ের রহমান চৌধুরী এবং মো. রেজাউল হক। আপিল বিভাগের কার্যতালিকার এক নম্বরেই মামলাটি রাখা হয়। গত ১৪ মে চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজকের দিনটি রায়ের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন আদালত।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর জন্য দেশের রাজনীতির মূলধারায় ফিরতে একটি বড় সুযোগ তৈরি হলো। দলটি এখন নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন ফিরে পেলে ২০২৬ সালের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। যদিও প্রতীক ব্যবহারের বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত, তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে ফের স্বীকৃতি পাওয়া জামায়াতের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি জয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট আবেদন করা হয়। ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে আদালত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতিও দেন। সে অনুসারে ২০১৩ সালের শেষ দিকে জামায়াত নিয়মিতভাবে ‘লিভ টু আপিল’ করে।
উল্লেখ্য, দলটি ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাভ করেছিল। এরপর একাধিক জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত। তবে ২০১৩ সালে হাইকোর্টের রায়ের পর থেকে দলটি আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি দলীয় পরিচয়ে। পরবর্তী সময়ে দলটির অনেক প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করলেও বড় ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
২০২3 সালের ১ আগস্ট, তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াতের অস্তিত্ব সংবিধান বিরোধী। এর আগে একাধিক শীর্ষস্থানীয় জামায়াত নেতাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়, যা দলটির ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা তৈরি করে। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের একাংশের মধ্যে দলটির বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাবও গড়ে ওঠে। তবে দলটি বরাবরই বলেছে, তারা একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত নেতারা ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে দায়ী, দল নয়।
জুলাই ২০২4-এ ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় ধরনের রদবদল ঘটে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর জামায়াতসহ অনেক দলই নতুন করে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ খুঁজছিল। এই পটভূমিতে জামায়াতের দীর্ঘদিনের আইনি লড়াইয়ে জয়ী হওয়া রাজনৈতিকভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আদালতের এই নির্দেশনা অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশন এখন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন পুনঃস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে দলটি আদৌ তাদের পুরোনো প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ফিরে পাবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কমিশনকে আইনি ও নীতিগতভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ আদালত এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো আদেশ দেয়নি।
নিবন্ধন পেলে জামায়াতকে নতুন করে রাজনৈতিক কর্মসূচি সাজাতে হবে। দলের সামনে রয়েছে সাংগঠনিক পুনর্গঠন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার মতো বড় বড় চ্যালেঞ্জ।
এই রায়কে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যেই নানান প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই রায় একটি মাইলফলক। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এই রায়ের সমালোচনা করে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধে সম্পৃক্ত একটি দলের নিবন্ধন বৈধ করা দেশের জন্য বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
বিরোধী দলগুলোর কেউ কেউ বলছেন, এই রায়ের ফলে দেশে একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক পরিসর তৈরি হবে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র আরও দৃঢ় হবে।
এই রায়ের ফলে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা জামায়াতে ইসলামী আবারও দেশের জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পেল। এখন সব চোখ নির্বাচন কমিশনের দিকে—তারা কীভাবে এই রায়ের বাস্তবায়ন করে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির রাজনৈতিক পরিণতি কী হয়, তা দেখার অপেক্ষা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ