
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-চীন বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীনা ব্যবসায়ীদের প্রতি একটি সুস্পষ্ট ও আকর্ষণীয় বার্তা দিয়েছেন: বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠছে, এবং এই উত্তরণে চীনা বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তিনি বলেন, এখনই সময় বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার, কারণ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে দেশটি।
রবিবার ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাল্টিপারপাস হলে আয়োজিত এই সম্মেলনে ড. ইউনূস তার উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, “বাংলাদেশে বিদ্যমান বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আমি আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প, ওষুধ, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, পাট, মৎস্য এবং তথ্য প্রযুক্তি — প্রতিটি খাতেই রয়েছে বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্বের অনন্য সুযোগ। এখানে বিনিয়োগ করে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব তৈরি করুন।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকার এবং চীন সরকার যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যেখানে অংশ নিয়েছেন চীনের ১০০টি কোম্পানির প্রায় ২৫০ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী। এ আয়োজন দুই দেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ৫০ বছরের মাইলফলক উদ্যাপনের অংশ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে অতীতের বিনিয়োগ-অপ্রাপ্তির কারণগুলোও খোলাখুলি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হলেও সেগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি — অনেক জায়গায় গরু চরেছে। দুর্নীতি, স্বৈরশাসন এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের দূরে ঠেলে দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “তবে আজ পরিস্থিতি বদলেছে। লাখ লাখ তরুণের নেতৃত্বে সংঘটিত জুলাই বিপ্লব সেই অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়েছে। আজকের সরকার, একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন হিসেবে, দেশের প্রশাসন ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে বদ্ধপরিকর।”
ড. ইউনূস জানান, বর্তমান সরকার বিডাকে একটি কার্যকর ও দক্ষ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছে। তিনি বলেন, “আমরা বিডার পরিচালনায় বেসরকারি খাতের সেরা মেধাবীদের নিয়ে এসেছি। বিনিয়োগকারীদের সমস্যা সরাসরি সমাধানের লক্ষ্যে রিলেশনশিপ ম্যানেজার নিয়োগ করছি এবং প্রতি মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রাতঃরাশ বৈঠকের আয়োজন করছি যাতে সরাসরি মতবিনিময়ের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়।”
তিনি সরকারের সদিচ্ছা তুলে ধরে বলেন, “আমরা বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে, নীতিমালা সহজ করতে এবং ব্যবসার জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এ উদ্যোগগুলোর লক্ষ্য বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং তরুণদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা।”
চীনা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনাদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশ-চীন অংশীদারিত্বের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি পাল্টে দিয়েছে চীনা বিনিয়োগ। আমরা আশা করি, এই সফর বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অনুরূপ পরিবর্তনের সূচনা করবে।”
তিনি জানান, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিজনেস সামিটে সবচেয়ে বড় বিদেশি প্রতিনিধিদল এসেছিল চীন থেকে। এ সম্মেলন চলাকালে একটি শীর্ষস্থানীয় চীনা টেক্সটাইল কোম্পানি কেবলমাত্র স্পিনিং খাতে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়, যা বাংলাদেশের শিল্পখাতের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার বার্তা।
ড. ইউনূস তার কয়েক মাস আগের বেইজিং সফরের কথা স্মরণ করে বলেন, “আমি চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ উৎসাহিত করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আমি সম্মানিত যে তিনি তার কথা রেখেছেন। চীনা কোম্পানিগুলো বিশ্বব্যাপী উৎপাদনে অগ্রগণ্য। বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি গেম চেঞ্জার হতে পারে এবং একই সঙ্গে লাখ লাখ তরুণের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করতে পারে।”
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে পাটের গুরুত্ব তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, “পাট আমাদের আবেগের সঙ্গে জড়িত। এটি কেবল বস্তার তন্তু নয়, বরং একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প — আমরা এতদিন এটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেইনি। এখন সময় এসেছে পাটকে শিল্প ও অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনার।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা পাটকে শুধু অর্থনীতির অংশ নয়, বরং পরিবেশ রক্ষার উপায় হিসেবেও বিবেচনা করছি। পাটের বহুমুখী ব্যবহার সম্ভব — জামদানি, ঢাকাই মসলিনসহ অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী কাপড়েও এর ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। এক সময় ঢাকাই মসলিন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রসিদ্ধ কাপড়। আজ আমরা চাই সেই গৌরব ফিরে আসুক।”
সম্মেলনের গুরুত্ব তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আপনাদের উপস্থিতি আমাদের দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক এবং পারস্পরিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে। এ বছর আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে — এই সম্মেলন তাই একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।”
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও চীনের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের একটি নতুন মাত্রা সূচিত হয়েছে। সরকার ও বেসরকারি খাতের একযোগে প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ কি সত্যিই পরবর্তী বড় ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে রূপান্তরিত হতে পারবে — সে প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে এখনকার সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী বাস্তবায়নের ওপর। তবে অধ্যাপক ইউনূসের কথায় আশার সুর স্পষ্ট: “আমরা যাত্রা শুরু করেছি — এবার এগিয়ে যাওয়ার পালা।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ