
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানায়ক, স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী আজ (৩০ মে)। ১৯৮১ সালের এই দিনে রাতে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। সেই সময় এই ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়কের বয়স ছিল মাত্র ৪৫ বছর। তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর শোক ও গভীর ক্ষতির অধ্যায় হিসেবে আজও স্মরণীয়।
এই দিনটি স্মরণে বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসমূহ আট দিনব্যাপী কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করছে। ভোর থেকে শুরু হয়েছে বিভিন্ন শ্রদ্ধানুষ্ঠান, আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল এবং মানবকল্যাণমূলক কর্মসূচি। বিএনপি বলছে, এবার দীর্ঘ ১৬ বছর পর স্বাধীনতার ঘোষকের শাহাদতবার্ষিকী কোনো সরকারি বাধা ছাড়াই পালিত হচ্ছে, যা এক নতুন বাস্তবতার প্রতিফলন।
জিয়াউর রহমান: এক সাহসী সৈনিক থেকে রাষ্ট্রনায়কে পরিণত
জিয়াউর রহমানের জীবন ছিল সংগ্রাম, সাহসিকতা এবং দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তার মধ্যে নেতৃত্বগুণের পরিচয় পাওয়া যায়। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৫৫ সালে কমিশন লাভ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মজীবন শুরু করেন।
সামরিক জীবনে শৃঙ্খলা, কঠোর পরিশ্রম ও কৃতিত্বপূর্ণ নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা বাংলাদেশের মানুষের জন্য হয়ে ওঠে প্রেরণার উত্স। তার সেই ঘোষণা সারা দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঢেউ তোলে এবং হাজার হাজার তরুণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে তিনি একটি সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন এবং বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাঁকে 'বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত করা হয়।
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অবদান
সিপাহি-জনতার বিপ্লবের পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। এরপর মাত্র ছয় বছরে তিনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বহু উদ্ভাবনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেন এবং একদলীয় স্বৈরতন্ত্র থেকে জাতিকে মুক্ত করেন। তাঁর শাসনামলে ‘উৎপাদনের রাজনীতি’র মাধ্যমে কৃষি, শিল্প ও রপ্তানিমুখী অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি হয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যায়। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অবহেলিত এই দেশকে তিনি একটি মর্যাদাপূর্ণ আত্মনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করার পথ দেখান।
তিনি ব্যক্তিজীবনে দুর্নীতিবিরোধী, সাদাসিধে এবং কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। কখনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কিংবা সুযোগসন্ধানী রাজনীতির সঙ্গে আপস করেননি। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
বিএনপির মহাসচিবের শ্রদ্ধাঞ্জলি ও প্রতিক্রিয়া
শহিদ রাষ্ট্রপতির শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “জিয়াউর রহমান এমন এক সময় জাতির নেতৃত্ব দিয়েছেন যখন দেশ চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি ছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বিধা ও সিদ্ধান্তহীনতায় দেশের মানুষ দিশেহারা, ঠিক সেই মুহূর্তে ২৬ মার্চ তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা জাতিকে দৃঢ় মনোবলে উজ্জীবিত করে। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ একটি সুসংগঠিত রূপ নেয় এবং বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন, “স্বাধীনতার পর দেশ যখন আবার দুঃশাসনের ফাঁদে পড়ে, তখন জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দৃঢ়পদে এগিয়ে আসেন। দেশের জনগণ তাঁকে ভালোবেসেছে, কারণ তিনি কখনো তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি। তার জনপ্রিয়তা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সহ্য করতে পারেনি বলেই তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।”
দীর্ঘদিন পর পূর্ণ মর্যাদায় আয়োজন
বিএনপি বলছে, দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ধরে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর এবার প্রথমবারের মতো পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতায় দিবসটি উদযাপনের সুযোগ পেয়েছে দলটি। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় সূচিত হয়। সেই প্রেক্ষাপটে এবার যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে দিবসটি পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
বর্ণাঢ্য কর্মসূচি
জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষিত আট দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—
আজ ভোরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত ও কালো পতাকা উত্তোলন
শেরেবাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ
বিভিন্ন মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল
রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আজ বিকালে আলোচনা সভা
দুস্থদের মাঝে চাল-ডাল ও বস্ত্র বিতরণ
বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ এবং পোস্টার প্রদর্শনী
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডেও একই ধরনের মানবকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া সারা দেশের জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, থানা ইউনিটগুলোও কর্মসূচির অংশ হিসেবে আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল ও ত্রাণ বিতরণ করছে।
শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শুধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক অবিস্মরণীয় দেশনায়ক, যিনি জাতিকে সংকটময় মুহূর্তে আলোর দিশা দেখিয়েছেন। তাঁর শাহাদতবার্ষিকীতে সমগ্র জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে এক মহান বীর সন্তানকে, যার আদর্শ আজও বিএনপি এবং কোটি মানুষের জন্য প্রেরণার বাতিঘর হয়ে আছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ