
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়াবিদদের ভাষায় এটি “মৌসুমি স্বাভাবিক” বর্ষণ হলেও বাস্তবে এই পরিমাণ বৃষ্টিই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা অচল করে দিতে যথেষ্ট হয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি, বাসাবাড়ির প্রবেশপথ থেকে স্কুল-হাসপাতালের সামনের পথ—সব জায়গায় জমেছে হাঁটুসমান পানি। জলমগ্ন সড়কে দুর্বিষহ যাতায়াত, যানজট, দুর্ঘটনা এবং জনভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে এসব সমস্যার প্রতিকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কোনো তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি। নাগরিক ভোগান্তি একদিকে, আর বরাদ্দকৃত হাজার কোটি টাকার কাজের দৃশ্যমান সুফল না পাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা এবং অদক্ষতার ওপর।
বর্ষা মৌসুমের আনুষ্ঠানিক সূচনা এখনো হয়নি। অথচ মে মাসের শেষদিকেই কয়েক দফা ভারি বৃষ্টিপাত রাজধানীর মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। এমন অবস্থায় সামনে বর্ষায় রাজধানীজুড়ে কী অবস্থা দাঁড়াবে, তা ভাবতেই শিউরে উঠছে অনেকেই। এ নিয়ে নগরপরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদদের মত, “আমরা ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে চাই, কিন্তু তার জন্য যে প্রাথমিক অবকাঠামো দরকার, তা আজও গড়ে উঠেনি। বরং প্রতিনিয়ত অবনতি হচ্ছে।”
সড়কে পানি, জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ—এ যেন ঢাকার চিরচেনা দৃশ্য। তবে ভ্রু কুঁচকানোর বিষয় হলো, এই অবস্থার জন্য কোনো আকস্মিক দুর্যোগ নয়, বরং পরিকল্পনার ঘাটতি এবং দখল-দূষণের দায় রয়েছে। রাজধানীর খাল, ডোবা ও নর্দমাগুলো দখল ও ভরাট হয়ে গেছে বহু আগেই। তবে সমস্যা হলো, এগুলোর যথাযথ পুনরুদ্ধার ও উন্নয়নে কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন এবং খাল পরিষ্কারের কাজে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। খাতভিত্তিক এই বাজেটের বড় অংশই খাল সংস্কার, নর্দমা নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় খরচের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলেই ঢাকার রাস্তাগুলো ডুবে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর বর্তমান ড্রেনেজ অবকাঠামো এই পরিমাণ বৃষ্টিও সামাল দিতে পারে না। নাগরিক ভোগান্তি থেকে উত্তরণের জন্য যেখানে খাল পুনরুদ্ধার, আধুনিক নর্দমা ব্যবস্থা এবং ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর সঙ্গে সংযোগ জরুরি ছিল, সেখানে পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের দূরত্ব থেকে যাচ্ছে ভয়াবহ রকমের।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, “ঢাকায় পানি নামার জন্য যথেষ্ট খাল বা খোলা জায়গা নেই। যা ছিল, তা দখল হয়ে গেছে। সেগুলো পরিষ্কার করার রুটিন কাজগুলোও হচ্ছে না।” তার মতে, একদিকে যখন ওয়াসা থেকে সিটি করপোরেশন খালের দায়িত্ব নিয়েছে, তখন তাদের উচিত ছিল একটি দক্ষ, পেশাদার সার্কেল গড়ে তোলা। কিন্তু তারা সেটিও করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, “কিছু রুটিন কাজ—যেমন খাল পরিষ্কার রাখা, ড্রেনেজ লাইন সচল রাখা, কোথাও সমস্যা দেখা দিলে তা দ্রুত সমাধান—এসব মৌলিক কাজও এখন অবহেলিত।” সিটি করপোরেশনে মেয়র ও কাউন্সিলর না থাকায় বর্তমানে প্রশাসনিক স্থবিরতা বিরাজ করছে। ফলে কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়নের গতি পাচ্ছে না।
রাজধানীর ৫০টিরও বেশি খাল ও শত শত ছোট-বড় ডোবা-পুকুর একসময় বৃষ্টির পানি শোষণ ও নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করত। কিন্তু পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা, এবং সরকারি সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় সেগুলো একে একে ভরাট হয়ে গেছে। বহু খালে এখন বক্সকালভার্ট তৈরি করে তার ওপরে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলোর নিচে পানি চলাচলের ন্যূনতম ব্যবস্থাও কার্যকর নেই। কোথাও আবার আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠেছে খালের জমিতে। ফলে বৃষ্টি হলেই সেই পানি জমে গিয়ে নগরবাসীকে দুর্ভোগে ফেলছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন একযোগে খাল ও নর্দমা পরিষ্কারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই নগরীর বড় একটি অংশ অচল হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ জানান, “বর্তমান প্রশাসকের নেতৃত্বে খাল ও নর্দমা পরিষ্কারের কাজ চলমান রয়েছে। ভারি বর্ষণে কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা হলেও তা দ্রুত অপসারণে আমরা তৎপর ছিলাম।” তবে তিনি স্বীকার করেছেন, ভারি বর্ষণে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. মো. সফি উল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, “বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা রোধ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তবে আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।” তিনি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে একটি খাল উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেই সঙ্গে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত এলাকাগুলোর সমস্যা নিরসনে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।
নগরবাসীর অভিযোগ, প্রতিবছর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে কিন্তু চোখে দেখা যায় না কোনো স্থায়ী সমাধান। সামান্য বৃষ্টি হলেই তারা পোহান সীমাহীন দুর্ভোগ। তাদের দাবি, এসব প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ও কার্যকারিতা যাচাইয়ে স্বতন্ত্র তদন্ত টিম গঠন করে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হোক। একইসঙ্গে নগর উন্নয়নের নামে বরাদ্দ করা অর্থের অপচয় বন্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে হলে পরিকল্পিতভাবে খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে। খাল উদ্ধার, নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, জলাধার সংরক্ষণ এবং পরিকল্পিত নির্মাণ—সবই করতে হবে সমন্বিতভাবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক জবাবদিহির প্রয়োজন এখন জরুরি।
অন্যথায় প্রতিবছরই ঢাকাবাসীকে “স্বাভাবিক বৃষ্টির অস্বাভাবিক দুর্ভোগ” পোহাতে হবে, আর খরচ হতে থাকবে আরও শত শত কোটি টাকা, যার কোনো হিসাব থাকবে না—থাকবে শুধু ভোগান্তির ইতিহাস।
বাংলাবার্তা/এমএইচ