
ছবি: সংগৃহীত
উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি নিম্নচাপে পরিণত হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর মানুষের জীবনে চরম দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা—এসব জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় টানা ভারী বর্ষণ, ঝড়ো হাওয়া এবং অতিপ্রবাহিত জোয়ারের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নদ-নদীতে পানি বিপৎসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যার ফলে ইতোমধ্যেই বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছে এবং নদীর পাড় ও বাঁধে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।
নদীভাঙন ও প্লাবনে ঘরছাড়া হাজারো মানুষ
বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীতে হঠাৎ জোয়ারের পানি বিপজ্জনকভাবে বাড়তে শুরু করে। তীব্র ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে সেই জোয়ার মিলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে পায়রা, লোহালিয়া, রামনাবাদ চ্যানেল, আগুনমুখা ও বুড়োগৌড়ঙ্গ নদীতে। পানি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকায় তা বিপৎসীমা ছাড়িয়ে পড়ে এবং অনেক স্থানে বাঁধ উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। রাত দেড়টার দিকে কিছুটা ভাটার পানি নামতে শুরু করলেও তার আগ পর্যন্ত অনেক পরিবারকে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে দেখা গেছে।
বিশেষ করে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়া, চরমোন্তাজ ও ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়ন এবং গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কয়েকটি গ্রাম একেবারে পানির নিচে চলে গেছে। পানি এমনভাবে ঢুকেছে যে, অনেকেই রাতভর নির্ঘুম কাটিয়েছেন। বহু পরিবারকে শিশু-বৃদ্ধসহ খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে হয়েছে।
রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি
দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ নিচু এলাকায় ইতোমধ্যে জলাবদ্ধতা এবং অকাল প্লাবনে ধান, শাকসবজি ও গৃহপালিত পশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, বরিশালের বহু স্থানে কাঁচা-পাকা রাস্তাও পানির নিচে তলিয়ে গেছে, যার ফলে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছে। বরগুনা ও পটুয়াখালীতে অন্তত কয়েক হাজার ঘরবাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নদী বন্দর ও মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা, সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ
পটুয়াখালী নৌ-বন্দর কর্মকর্তা মো. জাকী শাহারিয়ার জানিয়েছেন, উপকূলীয় নদী ও সমুদ্র পথে এখন সব ধরনের ছোট লঞ্চ, যাত্রীবাহী স্পিডবোট এবং মাছ ধরার ট্রলার চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে এসব নৌযানের চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
মহিপুর মৎস্য বন্দর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুমন দাস বলেন, সমুদ্র এখন উত্তাল এবং পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। তবে সরকারের জারি করা মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে সমুদ্রে কোনো ট্রলার নেই। তাই বড় কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা আপাতত নেই বলেই মনে করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষণ: বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব জানিয়েছেন, বর্তমানে জেলার বেশ কয়েকটি নদীতে পানি বিপদসীমার অন্তত ৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে বাঁধের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে এবং কিছু স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ভেঙে পড়ছে। স্থানীয়দের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে এবং কিছু জায়গায় জরুরি বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আতঙ্ক ও হুঁশিয়ারি
রাঙ্গাবালীর চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. বিপ্লব হাওলাদার বলেন, “ভয়াবহ জোয়ারের পানি এখন ইউনিয়নের প্রায় পুরোটা এলাকা ঢেকে ফেলেছে। আগুনমুখা নদীর পানি এখনও প্রবল বেগে ঢুকছে। মানুষ এখন আতঙ্কে রয়েছে, এমন অবস্থায় যেকোনো সময় বড় ধরণের বিপর্যয় ঘটতে পারে।”
স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং জরুরি সহায়তা কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বহু এলাকাতেই এখনও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।
উপকূলবাসীর আর্তনাদ এবং টেকসই প্রতিরোধ ব্যবস্থার দাবি
প্রতি বছর এমন দুর্যোগ উপকূলবাসীর জীবনে নেমে আসে। বাঁধের দুর্বলতা, আবহাওয়া ব্যবস্থার সংকেতের দুর্বলতা এবং পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের অভাব তাদের বারবার চরম দুর্ভোগে ফেলে দেয়। এবারের নিম্নচাপও সেই পুরনো ক্ষত আবার নতুন করে উপকূলবাসীর হৃদয়ে এনে দিয়েছে। মানুষ বলছে—জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে কেবল ত্রাণ নয়, চাই স্থায়ী সমাধান, শক্তিশালী বাঁধ, কার্যকর আগাম সতর্কবার্তা, এবং যথেষ্ট সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে, ভবিষ্যতের প্রতিটি দুর্যোগে উপকূল যেন নিঃস্ব হয়ে না যায়—সেই আশঙ্কাই এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে উপকূলবাসীর মনে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ