
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন আবারও সশস্ত্র দস্যুদের তৎপরতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী বিগত বছরগুলোতে বনটি দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হলেও, বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় এবং চাঁদাবাজির মতো অপরাধ আবারও তীব্রভাবে বাড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—এখন এই বিশাল বনাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে এক নতুন দস্যুবাহিনীর হাতে, যার নেতৃত্বে রয়েছে আলিফ ওরফে দয়ালবাবা নামের এক কুখ্যাত জলদস্যু।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের অপরাধজগতের পুরনো নিয়ন্ত্রক মজনুবাহিনী সম্প্রতি ৫৮ লাখ টাকার একটি চুক্তির মাধ্যমে বন নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়েছে দয়ালবাবার হাতে। এপ্রিলের মাঝামাঝি এই হাতবদলের পর থেকে দয়ালবাবা সুন্দরবনের অপরাধ কার্যক্রমের মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। চুক্তি অনুযায়ী, মজনু ইতোমধ্যে ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন এবং আগামী তিন মাসের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করা হবে। ইতিমধ্যে কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদও দয়ালবাবার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরপর মজনু পার্শ্ববর্তী একটি দেশে পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
সরকারি উদ্যোগে যে দস্যুদের আত্মসমর্পণ করানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আবারও সক্রিয় হয়ে পড়েছে। দয়ালবাবার বর্তমান বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা ৯ জন। এর মধ্যে চারজনই একসময় সরকারকে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে দয়ালবাবা নিজে ছাড়াও রয়েছে খোকাবাবু ও আব্দুল্লাহর নাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকি ফাঁকি দিয়ে তারা আবারও দস্যুবৃত্তিতে নেমেছে।
দয়ালবাবার বাহিনী সুন্দরবনে প্রবেশ করা জেলেদের কাছ থেকে এখন আগের চেয়ে বেশি চাঁদা আদায় করছে। আগে যেখানে নৌকাপ্রতি ২৫ হাজার টাকা দিতে হতো, এখন সেই চাঁদার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার টাকায়। চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চালানো হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এমনকি মুক্তিপণ আদায়ের জন্য জেলেদের ফোন দিয়ে তাদের স্বজনদের সামনে কান্নাকাটি করানো হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি শ্যামনগরের গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ, রমজান নগর, কৈখালী ও ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার মোট ১৫ জন জেলেকে অপহরণ করেছে এই বাহিনী। পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয় জেলে সমাজ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “সুন্দরবনের জলসীমা আরও সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে বয়াসিং এলাকায় বিজিবির একটি ভাসমান বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি) চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি, র্যাব, পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন বিভাগের সদস্যদের তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, বন বিভাগ সাধারণ টহলের পাশাপাশি ‘স্মার্ট টিম’-এর বিশেষ টহলও জোরদার করেছে। কোস্ট গার্ডসহ অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে শিগগিরই যৌথ অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে।
শ্যামনগর থানার ওসি হুমায়ুন কবির জানান, “আমরা দস্যুতা সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। রাতের টহলও বাড়ানো হয়েছে।” একইসঙ্গে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনী খাতুন বলেন, “উপজেলা প্রশাসন আন্তরিকভাবে কাজ করছে জলদস্যু নির্মূলে। সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা সভায় এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।”
তবে মাঠপর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। সুন্দরবনের মৎস্য ব্যবসায়ী ও বনজীবীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সোনার মোড় মৎস্য আড়তের সাধারণ সম্পাদক আবিদ হাসান আবেদার বলেন, “বনজীবীরা চরম বিপদের মধ্যে রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার বলেছিল, সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে। বাস্তবে তা হয়নি। যারা আত্মসমর্পণ করেছিল, তারাই এখন আবার দস্যুতা করছে।” তিনি বলেন, “বারো মাসের মধ্যে পাঁচ মাস বন কার্যক্রম বন্ধ থাকে সরকারি নিষেধাজ্ঞায়। বাকি সাত মাসে রোজগারের বড় একটা অংশ চলে যায় মহাজন, বাহিনী ও দস্যুদের হাতে। এতে পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।”
সুন্দরবনের মতো একটি প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এলাকা আজ সশস্ত্র দস্যুদের দখলে চলে যাচ্ছে। সরকার বাহিনীর ঘোষিত সফলতা বাস্তবে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আত্মসমর্পণ করেও দস্যুরা পুরনো পেশায় ফিরে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি। নতুন করে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করতে হলে কেবল বাহিনী বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন সুসংহত গোয়েন্দা তথ্য, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সমন্বয় এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তা না হলে, দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বারবার অপরাধীদের হাতে জিম্মি হতে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ