
ছবি: সংগৃহীত
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা বাড়িয়ে ফের খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার আচালং সীমান্ত দিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ মোট ১৯ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। স্থানীয় ও প্রশাসনিক সূত্র জানিয়েছে, সোমবার ভোররাতে ভারতের হরিয়ানা রাজ্য থেকে গ্রেফতার করা এ ব্যক্তিদের কোনো প্রকার পূর্ব নোটিশ ছাড়াই আচালং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়।
প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পুশইন হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু, নারী ও পুরুষ রয়েছেন। তাদের সবার অভিন্ন পরিচয়—এরা একসময় ভারতে অভিবাসন অথবা কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তবে কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না বলেই ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং পরে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ভারতের হরিয়ানা রাজ্য থেকে গ্রেফতারের পর প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া বা কূটনৈতিক যোগাযোগ ছাড়াই একেবারে সরাসরি খাগড়াছড়ি সীমান্তের আচালং এলাকা দিয়ে তাদের পুশইন করা হয়। এদের সবারই অবস্থান এখন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির কৃষ্ণ দয়াল বিওপির আওতাধীন ডিবি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যেখানে তাদের অস্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঞ্জুরুল আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “পুশইন হওয়া সবাই এখন বিজিবির হেফাজতে রয়েছে। তারা কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে ভারতে গেল, এবং আদৌ তারা বাংলাদেশের নাগরিক কি না—এসব যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যদি তারা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
জেলা প্রশাসক মো. ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকারও একই কথা জানান। তিনি বলেন, “পুশইন হওয়া সবাই এখন বিজিবির তত্ত্বাবধানে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে রয়েছে। আমরা তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে কাজ করছি। যদি নিশ্চিত হওয়া যায় তারা বাংলাদেশি, তাহলে তাদের নিজ নিজ জেলায় পাঠানো হবে।”
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে আগত এইসব নারী-পুরুষ ও শিশুদের সবার গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। বর্তমানে ডিবি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয় কেউ যেন তাদের সঙ্গে অসুস্থ উদ্দেশ্যে যোগাযোগ করতে না পারে, কিংবা তারা নিজে থেকেই এলাকা ছেড়ে যেতে না পারে—সে বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
এটাই চলতি মাসে প্রথম ঘটনা নয়। খাগড়াছড়ির সীমান্ত দিয়ে এর আগেও একাধিক দফায় বাংলাদেশি পরিচয়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষদের ঠেলে পাঠিয়েছে বিএসএফ। চলতি মে মাসেই অন্তত তিন দফায় এমন ঘটনা ঘটেছে। এই মাসে ইতিমধ্যেই ৭১ জনকে একইভাবে সীমান্ত দিয়ে পুশইন করা হয়েছে বলে প্রশাসনিক সূত্র জানায়। বারবার এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি সীমান্তের নিরাপত্তা, মানবিকতা ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রোটোকল অনুযায়ী কোনো দেশ থেকে নাগরিক ফেরত পাঠানোর সময় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের দূতাবাস ও প্রশাসনের সঙ্গে পূর্ব আলোচনা ও আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা আবশ্যক। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোনো রকম আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ না করে একতরফাভাবে বাংলাদেশে মানুষ ঠেলে পাঠিয়ে সীমান্ত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
পুশইন হওয়া নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে এমন আগন্তুকদের উপস্থিতি নিয়ে জনমনে ভীতি ছড়াচ্ছে। স্থানীয়ভাবে মানবিক সহায়তা দিলেও, সরকার যদি দ্রুত পরিচয় নিশ্চিত করে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে এটা বড় ধরনের সামাজিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।
বারবার ভারত কর্তৃক এই ধরনের পুশইনের ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত এই ঘটনার বিষয়ে কোনো বিবৃতি আসেনি। তবে সীমান্ত নিয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন সুশীল সমাজ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
খাগড়াছড়ির সীমান্ত দিয়ে বিএসএফের পুশইনের ঘটনা কেবল একটি মানবিক সংকট নয়, এটি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও কূটনৈতিক সৌহার্দ্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এ ধরনের ঘটনার নিরসনে কূটনৈতিক তৎপরতা ও কঠোর বার্তা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অন্যথায়, এই অনিয়ন্ত্রিত পুশইন ভবিষ্যতে বড় আকারের সীমান্ত উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ