
ছবি: সংগৃহীত
আকাশে কালো মেঘ দেখলেই উপকূলের মানুষের চোখে ভেসে ওঠে অতীতের বিভীষিকাময় স্মৃতি। বিশেষ করে যেসব এলাকায় বছর বছর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে ভেঙে পড়ে বেড়িবাঁধ, সেইসব অঞ্চলের মানুষ আজও ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটায়। ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থা’র সম্ভাব্য আঘাতের খবরে সেই আতঙ্ক আরও গভীরতর হয়ে উঠেছে। শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের অঞ্জলী রানী মন্ডল নিজের ভাঙনকবলিত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে জল নিয়ে বলেন, “আকাশে মেঘ দেখলেই মনে হয় সব আবার ভেসে যাবে। বাচ্চা-কাচ্চা আর গরু-ছাগল নিয়ে আবার দৌঁড়াতে হবে আশ্রয়কেন্দ্রে।”
বছরের পর বছর ধরে উপকূলের জনগণ বেড়িবাঁধ ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, প্লাবন এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় যে বেড়িবাঁধগুলো আছে, তার প্রায় ২০ কিলোমিটার এখন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, উপজেলায় মোট ১৪৫.৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২৭টি পয়েন্ট অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পূর্ব ইতিহাস যেমন আছে, তেমনি আছে বহু প্রাণহানির বেদনা, ফসলহানির ক্ষোভ, ও বসতভিটা হারানোর কান্না।
শ্যামনগরের ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়ন রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ-সংশ্লিষ্ট এলাকায়। ষাটের দশকে নির্মিত এই বাঁধের ওপর দিয়ে আঘাত হেনেছে অন্তত ১৫টি বড় ঘূর্ণিঝড়—যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিডর, আইলা, আম্পান, বুলবুল, মহাসেন, রেমাল। এসব ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বারবার বাঁধ ভেঙেছে, প্লাবিত হয়েছে ইউনিয়নগুলো, প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ ও গবাদিপশু। শুধু প্রাণহানিই নয়, কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে মাছ, কাঁকড়া প্রকল্প ও কৃষিজ ফসলেও। ফলে উপকূলজুড়ে রয়েছে এক স্থায়ী আতঙ্ক আর অসহায়ত্ব।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী ২৯ থেকে ৩১ মে'র মধ্যে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থা’ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এই পূর্বাভাসকে ঘিরে গোটা উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করে উৎকণ্ঠা। ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ—কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর, এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় নেই বললেই চলে।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, “প্রায় প্রতি বছরই বেড়িবাঁধে ফাটল ধরে বা ভেঙে যায়। এবার বুড়িগোয়ালিনীর অবস্থা সবচেয়ে বিপজ্জনক। পানি উন্নয়ন বোর্ড সহযোগিতা করছে ঠিকই, কিন্তু যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করার কথা, তারা যথাসময়ে কাজ শেষ করে না। এতে দুর্যোগ এলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়।”
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন আরও সরাসরি বলেন, “আমাদের ত্রাণের দরকার নেই। আমরা চিরকালই কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থেকেছি। আমাদের দরকার শুধু একটা টেকসই বেড়িবাঁধ। সেটা হলে মানুষ নিজের ঘরেই থাকতে পারবে, গবাদিপশু বাঁচবে, ক্ষেতের ফসল থাকবে।”
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম পল্টু জানান, “২৭ এপ্রিল সিংহড়তলী এলাকায় বেড়িবাঁধ ধসে পড়েছে। আরও তিনটি পয়েন্ট রয়েছে সমান ঝুঁকিতে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলেছি, কিন্তু প্রত্যাশিত সাড়া পাইনি। অথচ সময় এখনই—ঝড় আসার আগেই প্রতিরোধ না হলে পরে আর কিছু করার থাকবে না।”
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে অবশ্য প্রস্তুতির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ইমরান সরদার বলেন, “আমাদের কাছে জিও রোল, জিও শিট, পর্যাপ্ত লেবার ও বালগেট মজুদ রয়েছে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি আমাদের আছে।”
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রনী খাতুন বলেন, “১৫ মে আমরা উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক করেছি। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট চিহ্নিত করে জরুরি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন সর্বক্ষণ বিষয়টি নজরদারিতে রাখবে।”
তবে বাস্তবতার চিত্র বলছে অন্য কথা। যেসব এলাকায় বেড়িবাঁধ আগেও ভেঙে প্লাবনের সৃষ্টি করেছে, সেগুলো আজও জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পূর্ব ও পশ্চিম দুর্গাবাটি, দাতিনাখালি, আটুলিয়ার বড় কুপট, খোন্তাকাটা, সরদারবাড়ি, পদ্মপুকুরের কামালকাঠি, ঝাপা, চাউলখোলা, কাশিমাড়ীর মমিননগর, কৈখালীর মির্জাপুর, জয়াখালী, মুন্সীগঞ্জের মৌখালী গাজীবাড়ি, সিংহরতলী, গাবুরার নেবুবুনিয়া, গাগড়ামারি, কালিবাড়ী—এইসব এলাকাগুলো বরাবরই অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। অথচ বছরের পর বছর ধরে শুধু আশ্বাস মিলেছে, বাস্তব উন্নয়ন হয়নি।
একদিকে প্রকৃতির তাণ্ডব, অন্যদিকে সরকারি দফতরগুলোর সমন্বয়ের ঘাটতি—এই দুইয়ের ফাঁদে পড়ে উপকূলবাসী যেন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নিমজ্জিত। ‘মন্থা’ কতটা ভয়ংকর হবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু এই দুর্যোগ থেকে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কতটা কমানো যাবে, সেটা নির্ভর করছে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর। কারণ দুর্যোগ ঠেকানো না গেলেও প্রস্তুতি থাকলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে প্রতিহত করা সম্ভব।
বাংলাবার্তা/এমএইচ