
ছবি: সংগৃহীত
জামায়াতে ইসলামীর প্রতি একাত্তরের প্রশ্নে অবস্থান পরিষ্কার করার আহ্বান জানিয়ে বিতর্কে জড়ানোর পর এবার বিএনপির সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে সদ্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলা নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। নিজেদের একটি মধ্যপন্থী, সংস্কারমুখী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরলেও ক্রমে বিএনপি-জামায়াত ঘেঁষা বিরোধী জোটে অবস্থান নিয়ে এই দুই ঐতিহ্যবাহী দলের সঙ্গে বিরোধে জড়ানো এনসিপির জন্য রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
বিরোধের সূচনা: ইশরাককে ঘিরে সংঘাত
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনের করা মামলায় নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল তাকে জয়ী ঘোষণা করলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত ২৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক গেজেট প্রকাশ করে। এরপর থেকেই ইশরাককে শপথ গ্রহণ করানোর দাবিতে বিএনপির নেতাকর্মীরা ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে রাজপথে অবস্থান নেয়। শুরুতে এই আন্দোলন থেকে দূরত্ব বজায় রাখলেও পরে দলীয় সমর্থন জানায় বিএনপি।
তবে এনসিপি এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের অভিযোগ, আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত না নিয়েই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে, যা ইসির পক্ষপাতদুষ্ট আচরণকে প্রকাশ করে। এনসিপির বক্তব্যে ইঙ্গিত ছিল, বিএনপির প্রভাবেই এই সিদ্ধান্ত এসেছে।
এনসিপি এখন দাবি করছে, অন্তর্বর্তী সরকার থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে তারা। দলটির নেতারা অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনে নিয়োগ, আদালতে বিচার, এমনকি মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথ নিয়েও তারা বিএনপি ঘেঁষা উপদেষ্টাদের বাধার মুখে পড়ছেন।
বিরোধের গভীরে: ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ সংঘাত
এনসিপি নেতারা প্রকাশ্যে দাবি করছেন, সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে অনেকে বিএনপির পছন্দে নিয়োগ পেয়েছেন এবং তারা এনসিপির কর্মকাণ্ডে বারবার বাধা দিচ্ছেন। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে শুরু করে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, পাবলিক প্রসিকিউটর, বিচারপতি—সবক্ষেত্রেই বিএনপিপন্থী আধিপত্যের অভিযোগ এনেছে এনসিপি। এদের নিয়োগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং দলীয় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সরাসরি ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি তাদের।
সরকারে থাকা সত্ত্বেও যদি প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এনসিপির প্রতিপক্ষে চলে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে দলটির অবস্থান দুর্বল হবে বলেই আশঙ্কা করছে নেতৃত্ব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপি এখন এক গভীর দ্বন্দ্বের মুখোমুখি—যেখানে তারা neither inside nor outside of power.
আন্দোলনের রাজনীতি ও ছাত্র নেতৃত্বের বঞ্চনা
গত ৮ মে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছিল এনসিপি। তবে সেই কর্মসূচি দলীয় ফোরামে অনুমোদন না পেলেও মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর একক আগ্রহে তা বাস্তবায়ন হয়। জামায়াত, হেফাজত ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উপস্থিতিতে বড় আকার ধারণ করে ওই কর্মসূচি। কিন্তু ওই কর্মসূচিতে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় বাধা ও ‘গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ স্লোগানে এনসিপির উপদেষ্টা মাহফুজ আলম পরোক্ষভাবে জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের সমালোচনা করেন, যা এনসিপি ও ডানপন্থি দলগুলোর সম্পর্কেও টানাপড়েন তৈরি করে।
জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব: মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে চাপ
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের সময় এনসিপির বিরুদ্ধে উঠে আসে জাতীয় সংগীত অবমাননার অভিযোগ। এর জবাবে এনসিপি পরদিনই জামায়াতকে একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই পক্ষের কর্মীদের মধ্যে শুরু হয় বাকযুদ্ধ। কেউ কেউ এনসিপিকে ‘ভণ্ড’ আখ্যা দিয়ে বলেন—একদিকে জামায়াতের সঙ্গে রাজপথে, অন্যদিকে তাদের প্রতি চাপ সৃষ্টি।
পুরোনো অভিজ্ঞতা, নতুন ভাঙন
গত অক্টোবরেও রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের দাবিতে ব্যর্থ হয় এনসিপি। ডিসেম্বরে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ বাস্তবায়নের দাবিতেও তারা প্রত্যাশিত জনসমর্থন পায়নি। ফলে এবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সাড়া না পেলে নেতাকর্মীদের মনোবল আরও ভেঙে পড়ার শঙ্কা থেকেই রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াত, হেফাজত ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তোলে দলটি। তবে তাতে আদর্শিক সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
রাজনৈতিক অবস্থান: কোথায় দাঁড়াবে এনসিপি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনসিপির সংকট এখন বহুমাত্রিক। একদিকে আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান থেকে তারা রাজপথে জামায়াত, হেফাজতের সঙ্গে একাত্ম হলেও আদর্শিকভাবে তাদের সঙ্গে একমত নয়। অন্যদিকে, বিএনপির সঙ্গে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে সংঘাতে জড়ানোর ফলে তারা ঐক্যবদ্ধ বিরোধী ফ্রন্ট থেকেও বিচ্ছিন্ন হতে পারে। এ অবস্থায় এনসিপি কোনো রাজনৈতিক বলয়ের পুরোদমে অংশ হতে পারছে না, আবার নিরপেক্ষ অবস্থানেও থাকতে পারছে না।
রাজনৈতিক বাস্তবতার সামনে এনসিপি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘ সময় ধরে দুই প্রধান দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—সহ জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মীয় দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে সক্রিয়। এই বাস্তবতায় একটি নতুন দল হিসেবে এনসিপি যে রাজনৈতিক জায়গা খুঁজছে, তা খুব সহজ নয়। ক্ষমতায় থেকেও প্রশাসনিক সহায়তা না পাওয়া, বিরোধী ফ্রন্টে থেকেও পূর্ণ সমর্থন না পাওয়া—এ দুটি চাপে এনসিপি এখন এক রকম রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
একাত্তরের প্রশ্নে জামায়াতকে চাপে ফেলা, ইশরাক ইস্যুতে বিএনপিকে একহাত নেওয়া এবং প্রশাসনে বিএনপি-ঘেঁষা আধিপত্যের অভিযোগ তুলে এনসিপি নিজেদের আদর্শিক স্বাতন্ত্র্য প্রমাণ করতে চাইছে বটে, কিন্তু তাতে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। পরবর্তী নির্বাচনের আগে এনসিপি কী কৌশল গ্রহণ করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ