
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাম্প্রতিক প্রণীত আইনসমূহ দেশের মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করার আশঙ্কা তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বিস্তারিত বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং একইসঙ্গে তাদের শাসনের আওতাধীন ruling দল আওয়ামী লীগের সমর্থকদেরও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে নিপীড়ন করছে।
গত ১২ মে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি কঠোর সংশোধনী প্রবর্তন করা হয়, যা অন্তর্ভুক্ত করেছে রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ আরোপের ক্ষমতা। সংশোধনীর আওতায় অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের ওপর ‘অস্থায়ী’ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যা দলের সভা, প্রকাশনা, অনলাইন প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যাপক সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাকস্বাধীনতা গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রায় কার্যত বন্ধের পথে রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলির ভাষ্য অনুযায়ী, গুম মোকাবেলায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রণীত খসড়া আইন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় কর্তৃক পরিচালিত গুমের শিকার অনেক মানুষের পরিবারের জন্য এই আইন যথাযথ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম নয়। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই আইন হাসিনার শাসনামলে সংগঠিত রাষ্ট্রীয় গুমের শিকারদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পরিবর্তে, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদল উভয়ের উপর রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দমনপীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এর পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ও দলটির নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টিও সমালোচিত হয়েছে। ১৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে এবং বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হতে পারে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে দলটিকে প্রায় নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পথে চলছে সরকার। নির্বাচন কমিশনও এই নিষেধাজ্ঞার পর দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে, যা দলের নির্বাচনী কার্যক্রম ও রাজনৈতিক অস্তিত্বকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ আছে, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং সংগঠন বিলুপ্ত করার ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে প্রদান করা হয়েছে। এই সংশোধিত আইন সংগঠনের বিস্তৃত সংজ্ঞা প্রদান করে যেখানে রাজনৈতিক দল, সহযোগী গোষ্ঠী, অথবা দলের প্রচার বা সমর্থনে যুক্ত ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বিচার প্রক্রিয়ার মানদণ্ড বিবেচনায় এ ধরণের আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ সংগঠনগুলোর স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘনের শঙ্কা তৈরি করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের ওপর গত বছরের শাসনামলের দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক নিপীড়নের পুনরাবৃত্তি এ আইন ও নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাদের বক্তব্য, রাজনৈতিক দলের সমর্থনে প্রদত্ত যেকোনো বক্তৃতা বা কার্যকলাপের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ মানুষের মৌলিক স্বাধীনতার উপর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক নিষ্পত্তি নয়, বরং নিপীড়ন ও দমনপীড়নেরই বহিঃপ্রকাশ।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও স্বাধীনতার জন্য বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যে রাজনৈতিক পরিবেশে সরকার ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিরোধীদল ও নিজেদের সমর্থকদের ওপর একই ধরনের দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, সেখানে নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক মুক্তির নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক করেছে, তারা যেন মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সম্মত নীতি অনুসরণ করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই কঠিন সময় চলাকালে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দেশটির মানুষ একযোগে আশা রাখছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকার যেন ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থেকে একটি সাম্যবিচার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা ও মানুষের অধিকার রক্ষা করবে। অন্যথায়, এই জাতীয় আইন ও নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আরো বিচ্ছিন্ন ও সংঘর্ষপূর্ণ হয়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ও সামাজিক সংহতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ