
ছবি: সংগৃহীত
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন বলে তার অফিস নিশ্চিত করেছে। এটি শুধু ‘আগ্রাসী ধরনের’ নয়, বরং হাড়ে ছড়িয়ে পড়া একটি মেটাস্ট্যাটিক ক্যানসার। তার গ্লিসন স্কোর ৯ (গ্রেড গ্রুপ ৫) – যা স্কোরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের (১০) খুব কাছাকাছি। এর অর্থ, ক্যানসারটি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক এবং জটিল।
এ ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে পুরুষদের অন্যতম নীরব ঘাতক এই রোগটি আবারও আলোচনায় এসেছে। ক্যানসারটি কী, কেন হয়, এর লক্ষণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি এবং কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় – সবকিছু তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদন।
প্রোস্টেট ক্যানসার কী?
প্রোস্টেট একটি ছোট গ্রন্থি যা পুরুষের মূত্রথলির নিচে এবং পায়ুপথের সামনে অবস্থিত। এটি বীর্যের উপাদান তৈরিতে সাহায্য করে। এই প্রোস্টেট গ্রন্থির কোষগুলো যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় ও ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে প্রোস্টেট ক্যানসার বলা হয়।
বিশ্বে পুরুষদের মধ্যে এটি দ্বিতীয় সর্বাধিক নির্ণীত ক্যানসার। ওয়ার্ল্ড ক্যানসার রিসার্চ ফান্ড এবং সিডিসি বলছে, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি ১০০ জনে ১৩ জন পুরুষ এই ক্যানসারে আক্রান্ত হন।
কেন হয় প্রোস্টেট ক্যানসার?
এর নির্দিষ্ট কারণ এখনো নিশ্চিত নয়, তবে বেশ কিছু ঝুঁকির বিষয় শনাক্ত হয়েছে:
বয়স: ৫০ বছরের পর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে।
পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের সদস্যের মধ্যে (বিশেষত পিতা বা ভাই) কারো প্রোস্টেট ক্যানসার থাকলে ঝুঁকি দ্বিগুণের বেশি।
ব্রেস্ট ক্যানসারের ইতিহাস: পরিবারে কারো স্তন ক্যানসার থাকলে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ে।
খাদ্যাভ্যাস: উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার বেশি খাওয়া।
ওজন ও স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ঝুঁকি বাড়ায়।
গ্লিসন স্কোর কী?
প্রোস্টেট ক্যানসার কতটা আগ্রাসী তা নির্ধারণ করতে একটি স্কোরিং সিস্টেম ব্যবহৃত হয়, যাকে গ্লিসন স্কোর বলা হয়। এটি বায়োপসি করা টিস্যুর কোষের গঠন দেখে নির্ধারণ করা হয়।
স্কোর ২ থেকে ৬: কম আগ্রাসী
স্কোর ৭: মাঝারি আগ্রাসী
স্কোর ৮ থেকে ১০: অত্যন্ত আগ্রাসী
বাইডেনের স্কোর ৯ – এটি খুবই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ক্যানসারের পরিচায়ক।
প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ
প্রথম দিকে ক্যানসারটি প্রায়ই লক্ষণহীন থাকে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
ঘন ঘন প্রস্রাব করা
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বা কষ্ট
প্রস্রাব ও বীর্যে রক্ত আসা
যৌন অক্ষমতা বা ইরেক্টাইল ডিসফাংশন
হাড়ে ব্যথা (বিশেষত ক্যানসার ছড়িয়ে পড়লে)
ওজন কমে যাওয়া
সনাক্তকরণের পদ্ধতি
পিএসএ টেস্ট (Prostate-Specific Antigen): রক্তে পিএসএ’র মাত্রা বেশি হলে ক্যানসারের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
ডিজিটাল রেক্টাল এক্সাম (DRE): চিকিৎসক পায়ুপথে হাত ঢুকিয়ে প্রোস্টেটের আকার ও অস্বাভাবিকতা পরীক্ষা করেন।
প্রোস্টেট বায়োপসি: টিস্যু নমুনা নিয়ে মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া হয়।
এমআরআই: টিউমারের অবস্থান ও বিস্তার জানতে।
সিটি স্ক্যান/বোন স্ক্যান: ক্যানসার শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়েছে কি না, তা জানতে।
চিকিৎসা পদ্ধতি
চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যানসারের স্তর ও রোগীর সামগ্রিক শারীরিক অবস্থার ওপর:
সার্জারি (Prostatectomy): ক্যানসারসহ প্রোস্টেট অপসারণ।
রেডিয়েশন থেরাপি: রেডিওতরঙ্গে কোষ ধ্বংস করা।
হরমোন থেরাপি: অ্যান্ড্রোজেন হরমোন দমন করে কোষের বৃদ্ধি থামানো।
কেমোথেরাপি: ওষুধ প্রয়োগে কোষ ধ্বংস করা।
ইমিউন থেরাপি: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।
অ্যান্ড্রোজেন ডিপ্রাইভেশন থেরাপি (ADT): শরীরের পুরুষ হরমোন কমিয়ে ক্যানসারের বৃদ্ধিতে বাধা।
বাইডেনের ক্ষেত্রে কী চিকিৎসা হবে?
বাইডেনের প্রোস্টেট ক্যানসারটি হরমোন-সংবেদনশীল। অর্থাৎ, ক্যানসার কোষগুলো অ্যান্ড্রোজেন নামের হরমোনের ওপর নির্ভরশীল। এই ক্ষেত্রে ADT থেরাপি ব্যবহার করে শরীরে অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রা কমিয়ে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়।
জনস হপকিন্স মেডিসিন ও আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির তথ্যমতে:
প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত হলে ৫ বছর বেঁচে থাকার হার প্রায় ১০০%।
শরীরে ছড়িয়ে পড়লে (যেমন বাইডেনের ক্ষেত্রে) এই হার কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ২৮%।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসার উন্নতির ফলে অনেকেই ৪-৫ বছর বা তার বেশি সময় বেঁচে থাকেন।
প্রতিরোধই উত্তম পন্থা
৫০ বছর বয়সের পর নিয়মিত পিএসএ ও DRE পরীক্ষা করানো উচিত।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ (ফল, সবজি, শস্য), এবং নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য।
ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
স্ট্রেস কমানো ও পর্যাপ্ত ঘুম প্রোস্টেট স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
প্রোস্টেট ক্যানসার ধীরে বাড়ে, কিন্তু ছড়িয়ে পড়লে এটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। তাই সচেতনতা, নিয়মিত পরীক্ষা এবং সময়মতো চিকিৎসাই পারে জীবন বাঁচাতে। জো বাইডেনের মত একজন শীর্ষ নেতার আক্রান্ত হওয়া বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ