
ছবি: সংগৃহীত
উচ্চ রক্তচাপ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে হাইপারটেনশন বলা হয়, একে বহুদিন ধরেই নীরব ঘাতক (Silent Killer) নামে অভিহিত করা হয়ে আসছে। কারণ, এটি প্রাথমিকভাবে খুব একটা লক্ষণ প্রকাশ করে না, অথচ ধীরে ধীরে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বিশেষত হৃদপিণ্ডের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী হৃদরোগের যে বিস্তার ঘটেছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবেই চিহ্নিত করা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তচাপ যদি নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তবে তা হৃদপিণ্ডে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে, যা একপর্যায়ে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার মতো মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তাই জানা দরকার, ঠিক কতটা রক্তচাপ বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাস্তবিক অর্থেই উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে।
উচ্চ রক্তচাপ এমন একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে হৃদপিণ্ড থেকে রক্ত সঞ্চালনের সময় রক্তনালীগুলোর দেয়ালে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি চাপ পড়ে। এই চাপ বাড়তে বাড়তে একসময় শিরা বা ধমনী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এবং রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়। এর ফলে হৃদপিণ্ডকে বেশি পরিশ্রম করতে হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে হার্ট ফেলিউর, স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
হৃদপিণ্ডের প্রতিটি সংকোচনের সময় যে চাপ তৈরি হয় তাকে সিস্টোলিক চাপ এবং শিথিল অবস্থার সময়কার চাপকে ডায়াস্টোলিক চাপ বলা হয়। সাধারণত, ১২০/৮০ mmHg (মিলিমিটার অফ মারকিউরি) রক্তচাপকে আদর্শ বা স্বাভাবিক রক্তচাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর চেয়ে বেশি হলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে ধরা হয়, তবে কোন স্তরে এটি মারাত্মক হয়ে ওঠে সেটি জানাও গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বিভিন্ন হৃদরোগ গবেষণা কেন্দ্রের মতে, যখন রক্তচাপ ১৩০/৮০ mmHg ছাড়িয়ে যায় তখন থেকেই তা উচ্চ রক্তচাপের শুরুর ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে ১৪০/৯০ mmHg বা তার বেশি রক্তচাপকে ‘হাইপারটেনশন স্টেজ ২’ হিসেবে ধরা হয়, যা সরাসরি হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি বিকলের মতো প্রাণঘাতী ঝুঁকির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিস্টোলিক চাপ যদি ১৪০ বা তার বেশি হয় এবং ডায়াস্টোলিক চাপ ৯০ এর উপরে চলে যায়, তখন হৃদপিণ্ডের ওপর চাপ মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। এর ফলে ধমনীর দেয়াল পুরু হয়ে যেতে পারে, রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং হঠাৎ করেই হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হতে পারে, যা হার্ট অ্যাটাকের দিকে ঠেলে দেয়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক রক্তচাপ (১২০/৮০ mmHg) যাদের থাকে তাদের তুলনায় ১৪০/৯০ mmHg বা তার বেশি রক্তচাপ যাদের রয়েছে, তাদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ। দীর্ঘদিন ধরে এই মাত্রার রক্তচাপ বজায় থাকলে তা ধমনির গঠন বদলে দেয় এবং হার্টে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। এক পর্যায়ে, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে হৃদপিণ্ডে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হলো, এটি অনেক সময় কোনো দৃশ্যমান উপসর্গ ছাড়াই শরীরে ক্রমাগত ক্ষতি করে চলে। এজন্যই চিকিৎসকরা একে নীরব ঘাতক বলে থাকেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে:
তীব্র ও নিরবিচার মাথাব্যথা
মাথা ঘোরা বা ভারমুক্ত অনুভব
চোখে ঝাপসা দেখা বা লাল হওয়া
বুক ধড়ফড় করা বা ব্যথা
ক্লান্তি, বমি বমি ভাব
নাক দিয়ে রক্ত পড়া
শ্বাসকষ্ট
এই উপসর্গগুলোর যেকোনো একটি থাকলে অবহেলা না করে দ্রুত রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত।
যাদের জেনেটিকভাবে উচ্চ রক্তচাপ আছে
যারা ধূমপান করেন বা অতিরিক্ত মদ্যপান করেন
যারা অতিরিক্ত লবণ খেয়ে থাকেন
যারা ব্যায়ামহীন জীবনযাপন করেন
ওজন বা স্থূলতা যাদের আছে
যারা চরম মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন
উপরোক্ত ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে যারা নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করান না, তাদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হঠাৎ করেই দেখা দিতে পারে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এই অবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো:
নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করুন—বিশেষত যাদের পারিবারিক ইতিহাসে এই রোগ রয়েছে।
লবণ ও ফাস্টফুড কমান—অতিরিক্ত সোডিয়াম রক্তচাপ বাড়ায়।
ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করুন।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন—বিএমআই পর্যবেক্ষণ করুন।
ব্যায়াম করুন প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট।
স্ট্রেস কমান—মেডিটেশন, প্রার্থনা, এবং মানসিক প্রশান্তির উপায় চর্চা করুন।
প্রয়োজনে ওষুধ—চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ না করলেও, একবার উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে চিকিৎসার আওতায় থাকা জরুরি।
উচ্চ রক্তচাপ একটি ধীরে ধীরে শরীরকে গ্রাস করা রোগ, যার ফলাফল হতে পারে মুহূর্তেই প্রাণঘাতী হার্ট অ্যাটাক। তাই রক্তচাপকে কখনো হালকা করে দেখা উচিত নয়। প্রতিটি মানুষ, বিশেষ করে ৩০ বছরের পর, নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপের অভ্যাস গড়ে তুললে অনেক অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। মনে রাখতে হবে, সঠিক সময়ে সচেতনতা এবং চিকিৎসাই পারে হৃদরোগের মতো বিপজ্জনক জটিলতাকে ঠেকাতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ