
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আসন সীমানা পুনর্নির্ধারণে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) নতুন উদ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যা ২০০৮ সালের পর এবারই সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এরইমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার একটি সংশোধিত অধ্যাদেশ জারি করে আইনি জট খুলে দিয়েছে, ফলে কমিশন পুরোদমে কাজ শুরু করেছে।
১৯ মে পর্যন্ত ইসিতে জমা পড়েছে ৬৬টি আসন নিয়ে ৪১৬টি আবেদন, যার প্রায় ৯০ শতাংশই বিএনপিপন্থীদের। অধিকাংশ আবেদনেই ২০০১ সালের সীমানায় ফিরে যাওয়ার দাবি করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে পিরোজপুর-২ (১০৩টি), কুমিল্লা-১০ (৯২টি), ঢাকা-৭ (৩৬টি), ঢাকা-১, ২ ও ৩ মিলিয়ে (২৩টি)।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এবারের সীমানা পুনর্নির্ধারণে শহরভিত্তিক আসন কিছুটা কমিয়ে গ্রামীণ এলাকা বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ, অনেক শহরাঞ্চলে জনসংখ্যার তুলনায় আসন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। কমিশন জনসংখ্যা ও ভোটার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টায় আছে।
ইসি কমিশনার ও সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিটির সভাপতি মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “আমাদের নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য নেই। যাদের আবেদন যুক্তিসংগত, তা বিবেচনায় নেওয়া হবে। তবে সব আসনেই পরিবর্তন হবে, এমন নয়।”
তিনি আরও জানান, এক আসনের সীমা পরিবর্তনে আশেপাশের আসনগুলোতেও প্রভাব পড়তে পারে। এ কারণেই এবার ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।
নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন দায়িত্ব নিয়েই ইসির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন ২০০১, ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে কী পরিবর্তন হয়েছিল তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ তৈরি করতে। বিশেষ করে ২০০১ সালের কাঠামোয় ফেরার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তবে উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ইসি বড় কোনো পরিবর্তন না করে মাত্র ২৫-৫০টি আসনে সীমিত রদবদল করে। ২০১৮ সালে সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত আইনের ৮ ধারায় সংশোধন এনে বড় পরিবর্তনের পথও বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। এই ধারাটি এবার অন্তর্বর্তী সরকার সংশোধন করেছে, ফলে আইনি বাধা নেই।
এলাকাভিত্তিক পরিবর্তনের চিত্র
পিরোজপুর-২: এ আসনে ১০৩টি আবেদন জমা পড়েছে, যা সর্বাধিক। দাবিগুলোর বেশিরভাগই কাউখালী ও ভাণ্ডারিয়া উপজেলাকে কেন্দ্র করে। কেউ কেউ চান ইন্দুরকানীকে বাদ দিয়ে আগের কাঠামোতে ফেরা হোক।
ঢাকা-১, ২ ও ৩: ২৩টি আবেদনের বেশিরভাগে দাবি—দোহার উপজেলাকে পুরনো মতো ঢাকা-১ এবং নবাবগঞ্জকে ঢাকা-২ হিসেবে পুনর্বহাল করা হোক। দোহারের সাবেক মেয়র ও ছাত্রদলের সাবেক নেতারাও এই দাবিতে আবেদন করেছেন।
কেএম খালেকুজ্জামান অভিযোগ করেন, “২০০৮ সালে ফ্যাসিস্ট সরকারের কারসাজিতে আসন একীভূত করা হয়েছিল। এতে বরাদ্দ কমেছে, উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে।”
ঢাকা-৭: ৩৬টি আবেদন জমা হয়েছে। এর মধ্যে কামারাঙ্গীরচর থানার ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডকে ঢাকা-৭ এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি রয়েছে।
ঢাকা-৪, ১২, ১৬, ১৯ ও ২০: এই আসনগুলোতে আবেদন কম হলেও ঢাকার মোট আসন সংখ্যা ২০ থাকায় পরিবর্তন হলে বেশ কয়েকটি আসন প্রভাবিত হবে।
কুমিল্লা জেলা: এই জেলায় কুমিল্লা-১, ২, ৬, ৯ ও ১০ আসন মিলে ১০৪টি আবেদন জমা পড়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ পরিবর্তন হলে জেলার প্রায় সবকটি আসনের সীমানা নতুনভাবে আঁকা লাগবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির অভিযোগ ছিল, “সীমানা পরিবর্তনের মাধ্যমে দলটিকে হারানোর পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন ইসি।” ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩০টি আসন, বিএনপি মাত্র ৩০টি। এবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন মহাজোট আবারও পুরনো কাঠামোয় ফেরার দাবি তুলে একই আশঙ্কা প্রকাশ করছে।
সংসদীয় আসন পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ২০২৬-এর চেহারা অনেকটাই বদলে যেতে পারে। বিএনপির ব্যাপক অংশগ্রহণ ও ২০০১ সালের কাঠামোয় ফেরার জোরালো দাবি, ইসির নতুন উদ্যোগ, এবং আইনি সংশোধন—সব মিলিয়ে এবার বড়সড় সীমানা পরিবর্তনের বাস্তব সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে এটি কেবল প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস নয়, বরং নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরির এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ