
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের অপসারণ এবং রাজস্ব প্রশাসনে টেকসই ও অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের দাবিতে অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। সম্প্রতি ঘোষিত এ কর্মসূচির আওতায় রাজস্ব প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোয় একাধিক পর্যায়ে কর্মবিরতি এবং স্মারকলিপি প্রদানসহ লাগাতার কর্মসূচি পালন করা হবে। এর মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চলমান নীতিনির্ধারণী দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
বুধবার (২১ মে) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় রাজস্ব ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতারা এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের নেতারা বলেন, এনবিআর বিলুপ্ত করে একটি 'স্বায়ত্তশাসিত রাজস্ব সংস্থা' গঠনের জন্য যে অধ্যাদেশ খসড়া আকারে প্রণয়ন করা হয়েছে, তা দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ধ্বংস করার একটি ষড়যন্ত্র। এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে রাজস্ব কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের একযোগে আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
পরিষদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে রাজস্ব প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্বেগ ও আন্দোলনের যৌক্তিকতা উপস্থাপন না করে বরং প্রকৃত পরিস্থিতিকে আড়াল করেছেন। তার পক্ষপাতমূলক ও একতরফা ভূমিকার কারণেই আন্দোলন আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
চার দফা দাবির বিস্তারিত বিবরণ
সংগঠনটি চারটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি উত্থাপন করেছে, যেগুলো তারা অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে:
০১. এনবিআর বিলুপ্তির প্রস্তাব সংবলিত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। এই অধ্যাদেশ রাজস্ব ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সরিয়ে একপ্রকার ‘নির্বাহী কর্তৃত্বাধীন কর্পোরেট কাঠামো’ গঠনের পথ সুগম করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
০২. জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানকে অপসারণ করতে হবে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আন্দোলনরত কর্মচারীদের উদ্বেগ সরকারের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন না করে সংকট আরও ঘনীভূত করেছেন।
০৩. রাজস্ব সংস্কার পরামর্শক কমিটির সুপারিশসমূহ জনসম্মুখে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। যাতে সবার অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য রাজস্ব সংস্কার নীতি গড়ে ওঠে।
০৪. রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারে ব্যবসায়িক সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত নিয়ে টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে যে গোপনীয়তা ও একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ চলছে, তার বিরোধিতা করে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার দাবি তোলা হয়েছে।
কর্মসূচির পর্যায়ক্রমিক সূচি
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ তাদের ঘোষিত কর্মসূচিতে বিভিন্ন দপ্তর ও ইউনিটকে অন্তর্ভুক্ত করে সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে:
২২ মে (বৃহস্পতিবার): দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রধান উপদেষ্টা বরাবর প্রদান করা হবে। একই দিন ঢাকা এবং অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোর এনবিআর দপ্তরে "অবস্থান কর্মসূচি" পালন করা হবে। তবে রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এই কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।
২৪ ও ২৫ মে (শুক্র ও শনিবার): দেশের সব ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করা হবে। তবে কাস্টমস হাউস ও এলসি স্টেশনগুলোয় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আংশিক কর্মবিরতি চলবে। এ ক্ষেত্রেও রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হবে না।
২৬ মে থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য: কাস্টমস হাউস ও এলসি স্টেশনসহ সব ট্যাক্স, ভ্যাট ও কাস্টমস দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এই কর্মসূচির বাইরে থাকবে।
এই কর্মসূচির কারণে দেশের রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি যদি কর্মবিরতি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে তা আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, ভ্যাট সংগ্রহ এবং আয়কর দপ্তরের কাজকর্মে বড় ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে মে মাসের শেষভাগে যেহেতু ভ্যাট ও আয়কর দাখিলের সময়সীমা শেষ হয়, সেই সময়ে কর্মবিরতি কার্যকর হলে রাজস্ব ঘাটতি মারাত্মকভাবে বাড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকালে রাজস্ব বিভাগের এমন একটি অচলাবস্থা সরকারের জন্য বিপদসংকেত হয়ে দেখা দিতে পারে। এর পাশাপাশি এটি প্রমাণ করে, দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত রাজস্ব প্রশাসনের ভেতরে কতটা অস্থিরতা ও অসন্তোষ জমে উঠেছে।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের চার দফা দাবিকে ঘিরে রাজস্ব প্রশাসনে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি দ্রুত সমাধান না করা হয়, তাহলে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না এলেও পরিস্থিতি স্পষ্টতই সংকটজনক। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এই অচলাবস্থার অবসান ঘটানো না গেলে সামনে আরও কঠোর আন্দোলন ও বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকেই যায়।
বাংলাবার্তা/এসজে