
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ নিতে বাধা দিতে হাইকোর্টে করা রিট আবেদনের ওপর আদেশ বৃহস্পতিবার (২৩ মে) দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে আদালত। বুধবার (২১ মে) বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটের শুনানি শেষে এই দিন নির্ধারণ করেন। এর আগে গত সোমবারও (২০ মে) এ বিষয়ে শুনানি হয় এবং আজকের দিনটি আদেশের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আদালত এক দিন পর বৃহস্পতিবার আদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান।
রিটের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান মিলন এবং ইশরাক হোসেনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। পুরো প্রক্রিয়া এখন পর্যবেক্ষণে রয়েছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ও প্রশাসন।
এই রিট আবেদনের মূল বিষয়বস্তু ছিল—২০২০ সালের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের বিজয় বাতিল করে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা সংক্রান্ত নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বাস্তবায়ন এবং সেই অনুযায়ী তাকে শপথ নিতে দেওয়া নিয়ে। তবে রিটে আবেদনকারী পক্ষ থেকে ইশরাককে শপথ নিতে না দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও আবেদন জানানো হয়েছে।
রিটের পেছনের ইতিহাস ও আইনি প্রক্রিয়া:
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে প্রায় পৌনে ২ লাখ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে ইশরাক একটি মামলা করেন নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে চলতি বছরের ২৭ মার্চ ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম ওই নির্বাচনের ফল বাতিল করে ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন।
ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর ২২ এপ্রিল বিষয়টি গেজেট প্রকাশের জন্য নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে পরামর্শ চায়। পরবর্তীতে ২৭ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে গেজেট প্রকাশ করে।
আদালতের নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের:
তবে এই গেজেট প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৪ মে ঢাকার বাসিন্দা মো. মামুনুর রশিদ হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। আবেদনটি করা হয় ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ নিতে না দেওয়ার জন্য এবং একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে। রিটে বলা হয়, আদালতের ট্রাইব্যুনাল একটি অবৈধ রায় দিয়েছে, যা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের শামিল।
রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সড়ক অবরোধ:
এদিকে আদালতের এই মামলার পাশাপাশি রাজনৈতিক উত্তেজনাও তীব্র হয়েছে। ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা কয়েকদিন ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নগর ভবন ও মৎস্য ভবনের সামনের এলাকায় অবস্থান করছেন। তারা মেয়র পদে ইশরাকের শপথ গ্রহণ নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। এতে করে আশপাশের এলাকায় যান চলাচলে ভয়াবহ বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এসব এলাকায় চরম যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টি:
এই ঘটনা শুধু রাজধানীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মহলও বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য না এলেও, আদালতের বৃহস্পতিবারের আদেশের পরপরই পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা যেখানে আদালতের মাধ্যমে একজন পরাজিত প্রার্থীকে মেয়র হিসেবে ঘোষণার পাশাপাশি সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে—এবং এখন তার বাস্তবায়ন প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
ইশরাক হোসেনের মেয়র হওয়া এখন কেবল রাজনৈতিক নয়, একটি আইনি দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। এই দ্বন্দ্বের পরিণতি নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের শহর ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট যে আদেশ দেবে, তা শুধু একটি মেয়র শপথ গ্রহণের বিষয়ে নয়, বরং তা হবে আদালত, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ