
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, উত্তরা-কমলাপুর মেট্রোরেল, কক্সবাজার-গুনদুম পর্যন্ত রেললাইনসহ ২৫৮টি মেগা ও মধ্যম পরিসরের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) সম্প্রতি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নকালে এসব প্রকল্পে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ দিয়েছে এবং স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে যে, এগুলো নির্ধারিত সময়সীমা অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে শেষ করতে হবে।
রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এনইসি বৈঠকে উন্নয়ন পরিকল্পনার এ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় এবার সরকার কিছুটা কড়াকড়ি অবস্থান নিয়েছে। কারণ, বিগত বছরগুলোতে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এতে বাড়তি সময় ও ব্যয়ে প্রকল্প শেষ করতে হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে দেরিও হয়েছে।
সময়মতো প্রকল্প শেষ করতে কড়া নির্দেশনা
এনইসি বৈঠকে জানানো হয়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত এসব ২৫৮টি প্রকল্পের মধ্যে ২১২টি বিনিয়োগ প্রকল্প, ১১টি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং ১৭টি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নের প্রকল্প রয়েছে। এ সকল প্রকল্পেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং এনইসি বৈঠকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে—কোনো প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না।
যদিও চলতি অর্থবছরেও এমন কঠোর অবস্থানের পরও নির্ধারিত ৩১১টি প্রকল্পের মধ্যে অন্তত ২৩টি প্রকল্প সময়মতো শেষ করা সম্ভব হয়নি। এসব প্রকল্পও নতুন অর্থবছরের এডিপিতে ফের যুক্ত করে বরাদ্দ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ব্যর্থতার দায়ে জবাবদিহিতা চায় সাবেক পরিকল্পনা সচিব
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ বলেন, “লক্ষ্য নির্ধারণের পরও যদি প্রকল্প শেষ না হয়, তাহলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। নয়তো এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে। সময়মতো প্রকল্প শেষ না হলে তাতে ব্যয় বাড়ে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফলও পেতে দেরি হয়।”
কোন খাতের কত প্রকল্প?
সমাপ্তির তালিকায় থাকা ২৫৮টি প্রকল্প বিভিন্ন খাতের অন্তর্গত। পরিবহণ খাতের প্রকল্প সবচেয়ে বেশি—মোট ৪১টি। কৃষি খাতে ৩৯টি, পরিবেশ-জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ খাতে ২৫টি, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধা খাতে ২৩টি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ১৬টি, শিক্ষাখাতে ১৪টি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে ১১টি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১১টি, সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৯টি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৮টি, ধর্ম-সংস্কৃতি ও বিনোদন খাতে ৬টি এবং সাধারণ সরকারি সেবা ও জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষা খাতে দুটি করে প্রকল্প রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের তালিকা
সমাপ্তির লক্ষ্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে:
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প
উত্তরা-কমলাপুর মেট্রোরেল প্রকল্প
দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-গুনদুম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ
আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ
বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-শীতলক্ষ্যা-বালু নদীর তীরে পিলার স্থাপন
মোংলা বন্দরের জন্য সহায়ক জলযান সংগ্রহ
ময়মনসিংহ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প
বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক উন্নয়ন
ভুয়াপুর লিংক সড়ক নির্মাণ
১৫০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ এবং ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ
বিআইডব্লিউটিসির জন্য ৩৫টি বাণিজ্যিক ও ৮টি সহায়ক জলযান সংগ্রহ
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প
বহুমুখী দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প
আগের বছরগুলোর হিসাব কী বলছে?
বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এর তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৭৭টি প্রকল্প শেষ করার কথা থাকলেও বাস্তবে শেষ হয়েছে মাত্র ২৬৪টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৫৫টির বিপরীতে ২৯৪টি, আর ২০২০-২১ সালে ৪৩৯টির বিপরীতে শেষ হয়েছে মাত্র ২৩৬টি প্রকল্প।
অর্থনৈতিক সংকটেও বাস্তবায়নের ওপর চাপ
বলা চলে, দেশ যখন উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং রাজস্ব ঘাটতির মতো আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তখন উন্নয়ন প্রকল্প শেষ করার ক্ষেত্রে সরকারের কড়া অবস্থান একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। প্রকল্প বাস্তবায়ন সুশাসনের আওতায় আনতে না পারলে অর্থ অপচয় এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণ—দুটিই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এ কারণে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিকে বাস্তবধর্মী, সময়োপযোগী এবং ফলপ্রসূ করে তোলার ক্ষেত্রে প্রকল্প শেষ করার ওপর দেওয়া এ চাপ বাস্তবায়নে পুরো প্রশাসনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে—এটাই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ