
ছবি: সংগৃহীত
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতি চলছে। সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা কম হলেও অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের প্রধান ভরসাস্থল হিসেবে কাজ করবে। তবে এ ঋণ গ্রহণের মাত্রা ও এর প্রভাব নিয়ে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল সাত লাখ সাতানব্বই হাজার কোটি টাকা, যেখানে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার প্রায় সাত লাখ নব্বই হাজার কোটি টাকার আশেপাশে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ছিল প্রায় দুই লাখ চল্লিশ হাজার কোটি টাকা, যা পুরোপুরি পূরণে সরকার দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। আগামী অর্থবছরেও প্রায় একই পরিমাণ অর্থের ঘাটতি থাকার কথা, যা পূরণে সরকারি ঋণ নির্ভরতার মাত্রা অনিবার্য।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় সতেরো হাজার পাঁচশ কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ সুত্রত্রিশ হাজার পাঁচশ কোটি টাকা, কিন্তু এখন সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় নব্বই হাজার কোটি টাকা। এ বছরের প্রথম দশ মাসে সরকার ব্যাংক থেকে মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বছরের শেষ দিকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় কারণ তখন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অর্থের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে চলতি অর্থবছরের এই ঋণ গ্রহণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হওয়ায় আশার কথা থাকলেও আগামী অর্থবছরে ঋণের পরিকল্পনা বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সতর্ক করেছেন যে, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ সরবরাহকে সংকুচিত করে। গত ১২ মাসে ব্যাংকে আমানত বেড়েছে প্রায় এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার কোটি টাকা। সরকারের যদি এর মধ্যে থেকে এক লাখ কুড়ি হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়, তবে বাকি ২৫ হাজার কোটি টাকা বেসরকারি খাতের জন্য কম পড়বে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর।
ড. হোসেন আরও জানান, আগামী বাজেটে সাত লাখ নব্বই হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব থাকলেও বাস্তব রাজস্ব আয় হবে পাঁচ লাখের কিছু বেশি, এবং বিদেশি সহায়তা ও ব্যাংক ঋণের যোগে মোট বাজেট কার্যত সাত লাখ বিশ হাজার থেকে ত্রিশ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। বাজেটের পরিমাণ বেশি হলে তা বাস্তবায়ন কঠিন হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সরকার ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেয়, যা ব্যাংকগুলোর কাছে ঝুঁকিহীন ও লাভজনক হওয়ায় তারা বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি খাতে ঋণ দেওয়ায় বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর ফলে বেসরকারি খাত ঋণ সংকটে পড়ে, যা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।
চলতি অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ একান্ন হাজার ছয়শ কোটি টাকা, যার মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিকল্পনা ছিল নব্বই হাজার সাতশ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ষাট হাজার নয়শ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে সবচেয়ে বড় অংশ আসার কথা ছিল এক লাখ সাতত্রিশ হাজার পাঁচশ কোটি টাকা, বাকি অংশ আসবে সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে। তবে আসন্ন অর্থবছরের জন্য বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করে এক লাখ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যার মধ্যে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ এক লাখ বিশ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহ কমিয়ে মোট ২০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেছেন, সরকার কত টাকা ব্যাংক ঋণ নেবে তা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরামর্শ দিয়ে থাকে। তিনি উল্লেখ করেছেন, সম্প্রতি সফল বিনিয়োগ সম্মেলনের বাস্তবায়নের সময় এসেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সহায়তার জন্য বেসরকারি খাতের পর্যাপ্ত ঋণ পাওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে সরকারের উচিত ব্যাংক ঋণের মাত্রা এমনভাবে নির্ধারণ করা যাতে বেসরকারি খাতের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ অবশিষ্ট থাকে।
আগামী ২ জুন বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার, যা ব্যয় হ্রাস ও নতুন কোনো বড় প্রকল্প না নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব ঘাটতি কমাতে হবে। বাজেটে বিশেষভাবে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রক্ষা করা হবে। বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করলেও আগামী বাজেটে এটি ৬.৫ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই সুদহার বৃদ্ধি, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরণ এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে, যেখানে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা সহ বিভিন্ন সুরক্ষা কর্মসূচির অর্থায়ন বাড়ানো হবে এবং আরও বেশি সংখ্যক দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে এসব ভাতার আওতায় আনা হবে।
সুতরাং, আসন্ন বাজেট সরকারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হলেও ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা ও এর প্রভাব নিয়ে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। ব্যাংক ঋণ অতিরিক্ত হলে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে। এজন্য ঋণের মাত্রা নির্ধারণে সতর্কতা অবলম্বন ও অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ