
ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ছায়া এবার দৃশ্যমান দেশের বিনোদন অঙ্গনে। একদা রাষ্ট্রক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা বহু জনপ্রিয় শিল্পী আজ পড়েছেন বিপাকে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকেই শোবিজ অঙ্গনের বড় একটি অংশের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, আর তারই প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক নুসরাত ফারিয়ার গ্রেফতার ও জামিন প্রাপ্তির ঘটনাকে ঘিরে।
বিমানবন্দরে আটকের পর গ্রেফতার, তারপর কারাগার
জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও মডেল নুসরাত ফারিয়াকে ১৮ মে রাতে থাইল্যান্ড যাওয়ার সময় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এরপর তাকে ভাটারা থানায় হস্তান্তর করা হয় এবং সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে। সেখানে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে তোলা হয়। আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। দু’দিন পর, ২০ মে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
তাকে গ্রেফতারের কারণ হিসেবে জানানো হয়, জুলাইবিপ্লব চলাকালে ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডে নাকি তার সম্পৃক্ততা ছিল। মামলায় অভিযোগ, ফারিয়া সরাসরি স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তার পুরনো একটি বক্তব্য—“প্রত্যেক নারীর মধ্যে একজন করে শেখ হাসিনা আছেন”—তাকে ক্ষমতাসীন দলে ঘনিষ্ঠ বলে প্রমাণ করতে যথেষ্ট বলেই দাবি করছে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ।
বিভক্ত শিল্পী সমাজ: প্রতিবাদ বনাম প্রতিক্রিয়া
নুসরাত ফারিয়ার গ্রেফতার ও তার পরবর্তী ঘটনা শোবিজ অঙ্গনে ঝড় তুলেছে। অনেক শিল্পী সামাজিক মাধ্যমে এ গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানালেও, অন্য এক অংশ বলছে, আইন সবার জন্য সমান। একজন শিল্পীও যদি অপরাধে জড়িত থাকেন, তবে তার শাস্তি হওয়া উচিত। শুধু শিল্পী হলেই আইনের ঊর্ধ্বে নয় কেউ।
এও উল্লেখযোগ্য যে, বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে কিছু শিল্পী সরাসরি রাজনৈতিক সুবিধাভোগী হয়ে উঠেছিলেন। তারা নানা রকম রাষ্ট্রীয় সুবিধা, অনুদান, এমনকি সরকারি পুরস্কার ও সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। তাদের কেউ কেউ সরাসরি আওয়ামী লীগের হয়ে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন বা দলীয় মনোনয়ন পর্যন্ত চেয়েছেন।
পালাবদলে বদলে গেছে পরিস্থিতি
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকেই রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ শিল্পীরা এখন রোষানলে পড়েছেন। কেউ কেউ আত্মগোপনে, কেউবা বিদেশে পালিয়ে গেছেন। যারা দেশে রয়েছেন, তাদের অনেকেই শোবিজে কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আন্দোলনপন্থী শিল্পীরা তাদের সঙ্গে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করছেন।
অন্যদিকে, আন্দোলন চলাকালে যেসব শিল্পীরা রাস্তায় নেমেছিলেন বা ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তারা এখন বাহবা পাচ্ছেন। কিন্তু শাসনামলে সুবিধা নেওয়া তারকারা আজ বিভিন্ন ধরনের মামলার মুখে পড়ছেন কিংবা তীব্র সমালোচনার শিকার হচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে।
বিতর্কিত সিনেমা ‘মুজিব’ ঘিরে সমালোচনার ঝড়
এ পরিস্থিতিতে ফের আলোচনায় এসেছে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমা এবং তাতে অভিনয় করা তারকারা। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করা আরিফিন শুভ, শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করা নুসরাত ফারিয়া এবং ফজিলাতুন্নেছার চরিত্রে অভিনয় করা তিশা, শেখ রেহানার চরিত্রে সাবিলা নূর, শেখ লুতফর রহমানের চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী—এ সকল তারকারা একসময় সরকারি অনুদান, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পেয়েছিলেন।
তথ্য রয়েছে, শেখ হাসিনা নিজ হাতে শুভকে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একটি প্লট উপহার দিয়েছিলেন। তবে আন্দোলন-পরবর্তী সময় সেই প্লট বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। এসব শিল্পীদের কেউ কেউ এমপি হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়নও চেয়েছিলেন, যার মধ্যে অপু বিশ্বাস ও ফেরদৌস রয়েছেন। এখন তারা রাজনৈতিক সংযোগের দায়ে জনরোষের শিকার হচ্ছেন।
‘আলো আসবেই’ গ্রুপ এবং ছোটপর্দার প্রতিক্রিয়া
‘আলো আসবেই’ নামক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের স্ক্রিনশট ফাঁস হওয়ার পর, জানা যায় শিল্পী সমাজের একাংশ আন্দোলনের বিপক্ষে দলীয় প্রচারণায় সক্রিয় ছিলেন। ছোট পর্দার শিল্পী সংগঠন ‘অভিনয়শিল্পী সংঘ’ সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তারাও সমালোচিত হন। বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বিটিভিতে হামলার পর, তড়িঘড়ি করে শিল্পীদের দিয়ে সফর এবং সরকারের প্রতি সমর্থন জানানোও এই প্রতিক্রিয়ার অংশ বলে মনে করছেন অনেকেই।
রাজনৈতিক সুবিধাভোগের ফল এখন ভোগ করছেন শিল্পীরা
সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই মন্তব্য করছেন, রাজনৈতিক পক্ষপাত ও সুবিধাভোগের যে সংস্কৃতি শোবিজ অঙ্গনে গড়ে উঠেছিল, আজ তারই ফল ভোগ করছেন সেই সুবিধাপ্রাপ্তরা। কেউ কেউ বলছেন, “আপনি যখন শুধু শিল্পী নন, তখন আপনাকে রাজনৈতিক অবস্থানের দায়ও নিতে হবে।”
আওয়ামী লীগের আমলে মতাদর্শগত কারণে অনেক শিল্পী কালো তালিকাভুক্ত ছিলেন—এখন তারা ফিরছেন, আর তখনকার সুবিধাভোগীরা পড়ছেন সংকটে। শোবিজের কাজের পরিবেশ আজ বিভাজনের মুখে, সহকর্মীদের মধ্যেও স্পষ্ট দলীয় বিভাজন ও সন্দেহের সম্পর্ক বিরাজ করছে।
রাজনৈতিক পালাবদল এখন আর শুধু সংসদে সীমাবদ্ধ নয়, এর গভীর প্রভাব পড়েছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও। শিল্পীরা যেন আর শুধু শিল্পী নন—তারা হয়ে উঠেছেন রাজনৈতিক প্রতীকের অংশ। এই অবস্থায় শোবিজে অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে, তা শিল্পের স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত করবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিল্পের জগতে মত প্রকাশ ও আদর্শের স্বাধীনতা থাকলেও, রাজনৈতিক পক্ষপাত ও সুবিধাভোগ শেষ পর্যন্ত কোনো শিল্পীকে রক্ষা করতে পারে না—নুসরাত ফারিয়ার ঘটনা হয়তো সেই বার্তাই দিচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ