
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকাই চলচ্চিত্রে চিত্রনায়িকাদের গ্ল্যামার, স্টারডম আর জনপ্রিয়তার আড়ালে একের পর এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে, যা কেবল বিনোদনের জগতকে নয়, পুরো দেশের আলোচনায় স্থান করে নিচ্ছে। গত চার বছরে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের তিনজন শীর্ষস্থানীয় জনপ্রিয় নায়িকাকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করতে হয়েছে। সোমবার (২০ মে, ২০২৫) এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলেন চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়া, যাকে ঢাকার একটি আদালত জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদালত আগামী ২২ মে শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢালিউডের একটি বিতর্কিত ধারা নতুন করে আলোচনায় এসেছে, যেখানে একের পর এক শীর্ষ নায়িকার আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়া এবং কখনও কারাগারে, কখনও পুলিশের হেফাজতে কাটানো সময় যেন এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ধারাবাহিকতার সূচনা হয় ২০২১ সালের আগস্ট মাসে, যখন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পরীমনিকে র্যাব একটি বিশেষ অভিযানে বনানীর বাসা থেকে আটক করে। তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হয়। দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয় এই ঘটনায়। এরপর দীর্ঘ ২৭ দিন পর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তির পর পরীমনি আবার চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন এবং নিজের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মিডিয়ার আলোচনায় থাকেন। তবে এই ঘটনাটি তার ক্যারিয়ারে ও জনপ্রিয়তায় স্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলেছিল। পরীমনির এই গ্রেপ্তার এবং কারাবরণ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে নারীদের অবস্থান, নিরাপত্তা এবং বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলে।
২০২৩ সালের মার্চে আলোচনায় আসেন ঢালিউডের আরেক জনপ্রিয় মুখ মাহিয়া মাহি। সেই সময় তিনি এবং তার স্বামী সৌদি আরব থেকে একটি ফেসবুক লাইভে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। পরে মাহি দেশে ফিরলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পরপরই তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। প্রায় ১১ ঘণ্টা পুলিশের হেফাজতে থাকার পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। এই ঘটনাটি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় এবং পুলিশ ও রাজনীতির সম্পর্ক, পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক শুরু হয়।
এই দুই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০২৫ সালের ১৯ মে আলোচনায় এলেন জনপ্রিয় নায়িকা নুসরাত ফারিয়া। তাকে সোমবার ঢাকার একটি আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন এবং তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আগামী ২২ মে মামলার শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। যদিও তার বিরুদ্ধে মামলার বিস্তারিত বিষয় এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, তবে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হওয়ায় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। নুসরাত ফারিয়া দেশের অন্যতম গ্ল্যামারাস এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত চিত্রনায়িকা হিসেবে পরিচিত। তার এভাবে আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়া চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য একধরনের ধাক্কা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
এই তিনটি ঘটনাই একটি বিষয়ের দিকে আঙুল তুলেছে—ঢাকাই চলচ্চিত্রে নায়িকাদের আশ্চর্যজনকভাবে বিভিন্ন বিতর্ক ও আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে। এটি কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক প্রভাব, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এক সময় নায়িকাদের স্ক্যান্ডাল মিডিয়ার শিরোনাম হলেও তা মূলত ছিল গসিপ ঘরানার। কিন্তু এখন বাস্তবতা আরও কঠিন এবং আইননির্ভর। একজন নারী অভিনয়শিল্পীর যেকোনো মন্তব্য, সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট কিংবা ঘরোয়া ঘটনার ফলাফল হতে পারে জেল বা পুলিশি হয়রানিতে রূপ নেয়া—এই বাস্তবতা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসব ঘটনা ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের অভিনয়ে আসার আগ্রহেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন—এই ঘটনা শুধু কি ব্যক্তি নায়িকাদের ব্যর্থতা, নাকি এর পেছনে কাজ করছে বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক চক্রান্ত?
চার বছরে দেশের তিন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকার কারাগারে যাওয়া নিঃসন্দেহে ঢালিউড ইতিহাসে এক অনভিপ্রেত অধ্যায়। এসব ঘটনার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত মিলছে। সেইসঙ্গে চলচ্চিত্র অঙ্গন, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে—এই জনপ্রিয় মুখগুলো যেন শুধু স্ক্যান্ডালের শিকার না হয়ে পড়ে, বরং তারা আইন, নিরাপত্তা এবং সম্মানের সুষ্ঠু ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। তা না হলে, গ্ল্যামারের আড়ালের বাস্তবতা হয়ে উঠবে আরও ভয়ংকর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ