
ছবি: সংগৃহীত
বিতর্কিত সংগীতশিল্পী মাইনুল আহসান নোবেল আবারও গ্রেফতার হয়েছেন। এবার নারী নির্যাতনের মামলায় রাজধানীর ডেমরা থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সোমবার (২০ মে) গভীর রাতে ডেমরার শারুলিয়ার আমতলার নিজ বাসা থেকে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।
ডেমরা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, একটি নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে নারী নির্যাতনের মামলায় নোবেলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে তাকে আদালতে হাজির করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
ব্যক্তিজীবন ও বিতর্কের কুয়াশা
মাইনুল আহসান নোবেল সংগীতের জগতে পদার্পণ করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও, তার ব্যক্তিজীবন এবং আচরণ তাকে নিয়ে বারবার বিতর্কের কেন্দ্রে এনেছে। ভারতের জনপ্রিয় টেলিভিশন রিয়েলিটি শো 'সা রে গা মা পা'-তে অংশ নিয়ে রাতারাতি পরিচিতি পান তিনি। ওই শোতে তার সুরেলা কণ্ঠ ও ব্যতিক্রমী পরিবেশনা মুগ্ধ করেছিল উপমহাদেশের দর্শকদের। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও তৈরি হয় তার বিশাল ভক্তগোষ্ঠী।
তবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালীন সময় থেকেই তার ব্যক্তি জীবনের নানা অনিয়ম ও আচরণ নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। মাদকাসক্তি, উচ্ছৃঙ্খল জীবনধারা, অস্থির মানসিক অবস্থা, এবং বারবার বিয়ের সম্পর্ক তৈরি ও ভাঙার কারণে মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে তিনি নিয়মিত খবরের শিরোনাম হয়েছেন।
২০১৯ সালে সালসাবিল মাহমুদ নামে এক তরুণীকে বিয়ে করে আলোচনায় আসেন নোবেল। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি নিজের সংসারজীবনের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করে জানান দেন এক নতুন শুরু’র কথা। কিন্তু সংসার টেকেনি। অভিযোগ ছিল—নোবেল মাদক ছাড়তে পারেননি, বরং তার আচরণ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।
এরপর ২০২৩ সালের শেষ দিকে নোবেল আবারও বিয়ে করেছেন বলে জানা যায়। যদিও সেই সম্পর্ক নিয়েও সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা এবং সমালোচনার ঝড়।
আগেও গ্রেফতার হয়েছিলেন প্রতারণার মামলায়
এই প্রথম নয়—এর আগেও নোবেল গ্রেফতার হয়েছিলেন প্রতারণার মামলায়। ২০২৩ সালে একটি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার চুক্তি অনুযায়ী অগ্রিম টাকা নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হয়ে কোনো রকম ব্যাখ্যা না দিয়েই উধাও হয়ে যান। বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়, এবং পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সেই সময় তার বিরুদ্ধে পেশাগত দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগ উঠে আসে শিল্পী মহল থেকেও।
মঞ্চেও বিতর্কিত আচরণ
নোবেলের আচরণ শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, বরং মঞ্চেও প্রভাব ফেলতে থাকে। ২০২৩ সালে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতে গিয়ে তিনি মাদকের প্রভাবে অস্বাভাবিক আচরণ করেন বলে অভিযোগ উঠে। দর্শকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিত ভাষা এবং দম্ভোক্তির কারণে দর্শক ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। উপস্থিত হাজারো দর্শকের সামনে জুতা ও পানির বোতল ছুড়ে মারা হয় নোবেলের দিকে। মুহূর্তেই সেই দৃশ্য ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। নোবেলের প্রতি সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশজুড়ে।
সংগীত থেকে বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক অবক্ষয়
এক সময় যিনি দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে রকস্টারের মতো ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আলো নিভে আসে। নিয়মিত গান প্রকাশ না করা, স্টেজ পারফরম্যান্সে অনিয়মিত হওয়া, সহকর্মীদের সঙ্গে বিরোধ এবং নানান নাটকীয় কর্মকাণ্ড তার ক্যারিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সংগীতাঙ্গনের অনেকেই মনে করেন—নোবেল যদি তার প্রতিভাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতেন, আজ হয়তো তিনি বাংলাদেশের একজন অন্যতম সেরা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিবেচিত হতেন। কিন্তু মাদক, বিতর্ক ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারা তার প্রতিভাকে ম্লান করে দিয়েছে।
মাইনুল আহসান নোবেলের গ্রেফতার এবং তার বিরুদ্ধে আনা নারী নির্যাতনের অভিযোগ নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে তার ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, মামলাটি তার বর্তমান সম্পর্ককে ঘিরেই দায়ের করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মামলা তদন্তাধীন এবং আদালতের নির্দেশনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এক সময়কার আলোচিত কণ্ঠশিল্পীর এই পরিণতি তার ক্যারিয়ারের চরম বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়। সমাজ ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা বলছেন—সাহায্য ও পুনর্বাসন ছাড়া শুধু শাস্তি দিয়ে এমন মেধাবীদের রক্ষা করা সম্ভব নয়। সময় এসেছে, ব্যক্তি নোবেল নয়—সমাজের দায়বদ্ধতা থেকেও তার মতো প্রতিভাবান তরুণদের নিয়ে নতুন করে ভাবার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ