
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন তামিম, সাকিব, মাহমুদউল্লাহদের অভিজ্ঞতাকে পাশে রেখে নতুন নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনই বড় ধাক্কা খেল তারা মধ্যপ্রাচ্যে। সদ্য সমাপ্ত তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশের ২-১ ব্যবধানে হার সহযোগী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে, যার মাধ্যমে অধিনায়ক লিটন দাসের পূর্ণকালীন অধিনায়কত্বের যাত্রা শুরু হলো এক হতাশাজনক অধ্যায়ে।
অথচ লিটনের নেতৃত্বে এই সিরিজে বাংলাদেশ ফেভারিট হয়েই খেলতে গিয়েছিল। শক্তিমত্তা, অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান—সব দিক থেকেই বাংলাদেশ ছিল এগিয়ে। কিন্তু ক্রিকেট নামক অনিশ্চয়তার খেলায় এগিয়ে থাকার কাগুজে হিসাব অনেক সময়েই মুছে যায় মাঠের পারফরম্যান্সে। আর ঠিক সেটাই হলো শারজার তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে।
হতাশা নয়, বাস্তবতা মেনে নিলেন লিটন
শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ যখন মাত্র ৮৪ রান তুলেই ৮ উইকেট হারিয়ে বসে, তখনই মূলত পরিণতি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। ম্যাচের ফলাফল তো পরের বিষয়, দলের মানসিক ভরাডুবি হয়েছিল তারও আগে। আর ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে লিটন দাসও যেন ধৈর্য আর পরিণত মনোভাবেই প্রতিক্রিয়া জানালেন।
তিনি বলেন, “এখানে আসার সময়ে সব ম্যাচ জেতার কথাই ভেবেছি। কিন্তু এমনটা (সিরিজ হার) জীবনেরই অংশ। প্রতিপক্ষ যদি ভালো খেলে, তাদের কৃতিত্ব দিতেই হবে।”
এই বক্তব্যের মধ্যে যেমন পরাজয়ের বাস্তবতা মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত ছিল, তেমনি ছিল একটি নতুন নেতৃত্বের পরিণত ও সৎ স্বীকৃতি—যেখানে নিজেকে আড়াল না করে পরিস্থিতির স্বাভাবিকতাকে স্বীকার করা হয়।
ব্যাটিং ব্যর্থতা, শিশির আর টসের দুর্ভাগ্য
বাংলাদেশ দল তিন ম্যাচেই টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করেছে। শারজার উইকেট ব্যাটিং সহায়ক হলেও রাতের শিশির ব্যাটিংকে আরও সহজ করে দেয়, বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে। আর সেই সুবিধাটা বারবার কাজে লাগিয়েছে আমিরাত।
শেষ ম্যাচে ব্যাটিংয়ের শুরুতেই বিপর্যয় নেমে আসে বাংলাদেশের ওপর। শুরুর ছয় ওভারের মধ্যেই ৫ উইকেট হারানো দলটি শেষ পর্যন্ত ৮৪ রানে গুটিয়ে যায়। এটিই ছিল বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে অন্যতম সর্বনিম্ন সংগ্রহ।
লিটন বলেন, “আজ আমরা ব্যাটিংয়ে কিছু ভুল করেছি। এই কন্ডিশনে, এই উইকেটে এমন কিছু আমরা করতে চাইনি। তিন ম্যাচেই আমরা আগে ব্যাট করেছি, শিশিরই মূল নিয়ামক ছিল এখানে।”
এখানেই শেষ নয়। আগের ম্যাচে বাংলাদেশ ২০৫ রান করেও হার মানে, যা পরিস্থিতির গভীরতাই নির্দেশ করে। শিশিরে বল ভেজে গেলে স্পিন কিংবা পেস—কোনো বোলিংই কার্যকর থাকে না, আর সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে জয় ছিনিয়ে নেয় আমিরাত।
প্রতিপক্ষের প্রশংসা করতেও ভুল করলেন না লিটন
যখন একটি দল হেরে যায়, তখন সাধারণত আত্মপক্ষ সমর্থন করাটাই সহজ পথ। কিন্তু লিটন দাস এড়িয়ে গেছেন সে পথ। তার বক্তব্যে যেমন নিজের দলের ভুলের কথা উঠে এসেছে, তেমনি প্রতিপক্ষের সাফল্যের প্রতি প্রাপ্য সম্মানও দিয়েছেন।
“তারা খুবই ভালো খেলেছে, ভালো বল করেছে। কিন্তু ব্যাটিংয়ে তারা শিশিরের সুবিধা পেয়েছে। তারা আতঙ্কিত হয়নি, কৌশলী ব্যাটিং করেছে—তাদের কৃতিত্ব তাই দিতেই হবে,” বলেন লিটন।
এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আর এখন আমিরাতে
এটি বাংলাদেশ দলের জন্য প্রথমবার নয়, যখন তারা কোনো সহযোগী দেশের বিপক্ষে সিরিজ হারল। গত বছর মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হেরেছিল সাকিব-তাসকিনরা। এবারও প্রায় একই সময়ে, এক বছর পর, আরেক সহযোগী দেশ আমিরাতের কাছে হারল বাংলাদেশ।
এ দুই ঘটনায় একটি বিষয় পরিষ্কার—বাংলাদেশ ক্রিকেটে একটি বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে ধারাবাহিকতা ও পরিকল্পনার ঘাটতি নিয়ে। যেখানে দীর্ঘদিন ধরে খেলোয়াড়দের রোটেশন, সিনিয়র-জুনিয়রের ভারসাম্য কিংবা টিম ম্যানেজমেন্টের কৌশল নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে।
আগামীর দিকে তাকিয়ে
এই হারের পর শুধু সমালোচনাই নয়, বরং প্রয়োজন কঠোর আত্মসমালোচনা ও পরিবর্তনের সাহস। বাংলাদেশ দল যে এখন শুধু ফরম্যাটের ভেতর টিকে থাকার নয়, বরং আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চায়—তা বারবার বলা হলেও মাঠের পারফরম্যান্স তেমন কিছু বলছে না।
লিটন দাস এই হারের পরও ভেঙে পড়েননি। বরং তিনি বোঝাতে চেয়েছেন—এটা হারের নয়, শেখার সময়। আর নেতৃত্বের এই দায়িত্ব যখন তার কাঁধে, তখন তাকে সেই শিক্ষা থেকেই ভবিষ্যতের সঠিক পথ বের করে নিতে হবে।
এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এই হারের প্রেক্ষিতে কতটা আত্মসমালোচনার জায়গা তৈরি করে এবং সামনের সিরিজগুলোতে নতুন পরিকল্পনায় দল সাজাতে পারে কিনা।
শেষ কথা, লিটনের মুখে উচ্চারিত এই কথাগুলো হয়তো ভক্তদের কিছুটা সান্ত্বনা দিতে পারে— "এমন হারও জীবনের অংশ।"
বাংলাবার্তা/এমএইচ