
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার একটি আদালত জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও গায়িকা মেহের আফরোজ শাওন, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদসহ মোট ১২ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। নিষেধাজ্ঞাটি এসেছে একটি চাঞ্চল্যকর মামলার প্রেক্ষিতে, যা দায়ের করেছেন শাওনের সৎ মা নিশি ইসলাম।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ছানাউল্ল্যাহ বাদীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দেন। আদালতে বাদীপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. পিন্টু। তিনি আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন, মামলার বিচারাধীন অবস্থায় অভিযুক্তরা যাতে দেশের বাইরে পালাতে না পারেন, সে কারণে তাদের বিদেশগমনে নিষেধাজ্ঞা অত্যাবশ্যক। আদালত সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে নিষেধাজ্ঞা দেন।
নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ১২ জন হলেন— মেহের আফরোজ শাওন (অভিনেত্রী ও গায়িকা), হারুন অর রশীদ (সাবেক ডিবি প্রধান), নাজমুল ইসলাম (সিটিটিসি ইউনিটের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার), ইঞ্জিনিয়ার মো. আলী (শাওনের বাবা), মাহিন আফরোজ শিঞ্জন (শাওনের বোন), সেঁজুতি, সাব্বির (শিঞ্জনের স্বামী), সুব্রত দাস, মাইনুল হোসেন, পুলিশ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া, উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহ আলম ও মোখলেছুর রহমান মিল্টন।
এর মধ্যে পুলিশ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া ও এসআই শাহ আলম জামিনে রয়েছেন। বাকি ১০ আসামি বর্তমানে পলাতক এবং তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই গত ২২ এপ্রিল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ১৩ মার্চ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিশি ইসলাম মামলাটি দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, নিশিকে প্রতারণার মাধ্যমে বিয়ে করেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আলী। তিনি ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ৫০ লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করে নিশিকে বিয়ে করেন, কিন্তু তার পূর্বের বৈবাহিক সম্পর্ক ও সন্তানদের বিষয়টি গোপন রাখেন।
বিয়ের পর পরই তিনি জানতে পারেন মো. আলীর আগের স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে মো. আলী নানা ছলচাতুরী ও প্রতারণার আশ্রয় নেন। এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি আগেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন এবং তার আগের ঘরে একটি ছেলে ও তিনটি মেয়ে রয়েছে, যাদের মধ্যে একজন মেহের আফরোজ শাওন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শাওনের বোন শিঞ্জন ও তার স্বামী সাব্বির বাদীর বাসায় গিয়ে তাকে বিয়ের তথ্য গোপন রাখার জন্য ভয়ভীতি দেখান। এরপর ৪ মার্চ মো. আলী অসুস্থতার অজুহাতে নিশিকে গুলশানে ডাকেন। সেখানে গিয়ে তিনি মো. আলীর প্রথম স্ত্রীকে দেখতে পান এবং প্রতারণার বিষয়ে নিশ্চিত হন।
সে সময় উপস্থিত অন্যান্য আসামিরা তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। ৫ মার্চ শাওন, এডিসি নাজমুল ইসলামসহ কয়েকজন তার বাসায় প্রবেশ করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে। স্বাক্ষর না দেওয়ায় শাওন তাকে মারধর করেন। এতে নিশি অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়।
ঘটনার পর ২৪ এপ্রিল নিশিকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেন ডিবির পরিদর্শক শাহ জালাল। সেখানে গিয়েও তিনি শাওনসহ অন্যান্য আসামিদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। এমনকি ডিবি প্রধান হারুন বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নিশির বিরুদ্ধে মামলা নিতে নির্দেশ দেন।
পরবর্তীতে নিশির বিরুদ্ধে সাজানো মাদক মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে 'মাদক ব্যবসায়ী' হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা চালানো হয়।
এ মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের ১ জুলাই। জামিনে থাকা দুই আসামি ইতোমধ্যে আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। আদালত চলমান মামলার প্রেক্ষিতে যেকোনো সময় আসামিরা দেশত্যাগ করে প্রক্রিয়া বানচাল করতে পারেন—এই আশঙ্কা থেকেই তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার নির্দেশ দিয়েছেন।
এই মামলাটি বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য এবং শোবিজ অঙ্গনের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগে ভরপুর একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সৎ মা ও দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি এমন আচরণ, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার সহযোগিতা, ও আইনকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগ সাধারণ জনগণের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এই মামলা প্রমাণ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পারিবারিক প্রতারণা কীভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। পরবর্তী শুনানিতে নতুন কোনো তথ্য বা সাক্ষ্য উন্মোচিত হলে মামলার গতিপথ গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে পারে বলে আইনজীবীরা মন্তব্য করেছেন।
এখন দেখার বিষয়—দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ায় অভিযোগগুলোর সত্যতা কতটুকু প্রমাণিত হয় এবং ন্যায়বিচার কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ